E-Paper

মনোরোগীদের আত্মকথন উদ্ভাসিত অন্য ক্যানভাসে

গল্প বলিয়েরা হলেন মানসিক রোগী। বৃহত্তর সমাজের বড় অংশই যাঁদের ‘পাগল’ বলে ভাবতে অভ্যস্ত। সেই ভাবনার মূলে আঘাত করতেই ‘ম্যাড স্টোরিজ়’ নামে এই ইনস্টলেশন হাজির করেছে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কর্মরত সংগঠন অঞ্জলি।

সুনীতা কোলে

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:৩৬
মনোরোগীদের কথা নিয়ে ‘ম্যাড স্টোরিজ়’ ইনস্টলেশন। সোমবার, দক্ষিণ কলকাতার একটি শপিং মলে।

মনোরোগীদের কথা নিয়ে ‘ম্যাড স্টোরিজ়’ ইনস্টলেশন। সোমবার, দক্ষিণ কলকাতার একটি শপিং মলে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

দক্ষিণ কলকাতার আলোকিত, সুসজ্জিত শপিং মল। উৎসবের দিনে সন্ধ্যার দিকে ভিড় বাড়ছে ক্রমশ। তার মধ্যেই মলের একতলার প্রশস্ত পরিসরে রয়েছে পুরনো, মলিন পোশাক, নানা ছবি-কথার কোলাজে একটি উপস্থাপনা। যে পরিসর পুজো, নববর্ষ, বড়দিন উপলক্ষে সেজে ওঠে, সেখানেই হাজির করা হয়েছে ক্রিসমাস ট্রি-র আদলে এই স্থাপন শিল্প। তবে তার চেহারা ক্রিসমাস ট্রি-র চেনা ছকের বাইরের গল্পই বলে। আর সেই গল্প বলেন যাঁরা, তাঁদের গল্প বলার পরিসরটুকুও জোটে না বেশির ভাগ সময়ে।

এই গল্প বলিয়েরা হলেন মানসিক রোগী। বৃহত্তর সমাজের বড় অংশই যাঁদের ‘পাগল’ বলে ভাবতে অভ্যস্ত। সেই ভাবনার মূলে আঘাত করতেই ‘ম্যাড স্টোরিজ়’ নামে এই ইনস্টলেশন হাজির করেছে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কর্মরত সংগঠন অঞ্জলি। সংস্থার কর্ণধার রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘পাগল শব্দটা ব্যবহারে আমার আপত্তি আছে এবং থাকবে। কারণ, শব্দটা ব্যবহার হয় কাউকে দাগিয়ে দিতে, কোণঠাসা করতে। তবে পাগল আর ‘ম্যাড’ অর্থাৎ খ্যাপামি এক নয়। মানসিক ভাবে বিপন্ন মানুষদের কথা তাঁদেরই মুখে তুলে আনতে চেয়েছি।’’ তিনি জানাচ্ছেন, একটু অন্য রকম সব কিছুকে যে প্রান্তিকীকরণের চেষ্টা চলে, মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রটিও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই এই প্রান্তিক ‘অন্য রকম’ মানুষদের কথা তাঁদের নিজেদের বয়ানে হাজির করা হয়েছে। তার পরিকাঠামোগত প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখেই বেছে নেওয়া হয়েছে সাউথ সিটি মলকে। সেখানেই সোমবার উদ্বোধন হয়েছে এই প্রদর্শনীর। চলবে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত।

এই মনোরোগীদের অনুমতি নিয়ে তাঁদের কথা বৃহত্তর পরিসরে হাজির করার কাজে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, সেই মনোসমাজকর্মী ও শিল্পীরা জানাচ্ছেন, এই সব প্রান্তিক মানুষদের জীবন অনেক সময়েই পর্যবসিত হয় কেবল রোগের উপসর্গে। আবার অনেকের কাছে তাঁরা কেবলই বিপন্নতার কাহিনি। কিন্তু রোগ ছাড়াও যে তাঁদের যাপনে জড়িয়ে আছে আরও পাঁচটা দিক। তাই ওড়িশার তৃপ্তির মনে পড়ে ছাপাখানায় কাজ করার স্মৃতি। জিতেশ আবার চিন্তিত দোকানের মালিকানা নিয়ে, মামলায় সুরাহা হলে কিছু টাকা সন্তানদের জন্য রাখতে পারবেন বলে আশা তাঁর। সুজাতার মুখে শোনা যায় বাবা-মা বেঁচে থাকতে পড়াশোনা করার কথা। কাঁচাপাকা চুলের প্রৌঢ়া রেবা ইচ্ছা প্রকাশ করেন, লেখাপড়া-সেলাই শিখবেন। আর প্রায় সকলের কথাতেই ফিরে ফিরে আসে বাড়ির অনুষঙ্গ। কারও বাড়ি ফিরতে চাওয়ার আর্তি, কারও বাড়িটা কোথায়, তা ভুলে যাওয়ার বিষাদ, আবার কারও কাছে বাড়ি মানে আম-পেয়ারা গাছের স্মৃতি।

তাঁদের স্মৃতি-বিষাদের কাহিনি এ দিন কেনাকাটা, উদ্‌যাপন বা নিছক সময় কাটানোর মধ্যেই টেনে আনছিল সাধারণ মানুষকে। বাড়ির জন্য কিছু জিনিস কিনে ফেরার পথে কিউআর কোড স্ক্যান করে ভিডিয়োয় এক মনোরোগীর কথা শুনছিলেন তরুণী অনুরাধা নায়ার। বললেন, ‘‘আমার মনে হল, একটা দেওয়াল মনোরোগীদের থেকে আমাদের আলাদা করে রেখেছে। ওঁরা কেন নিজেদের কথা বলার সুযোগ পাবেন না, এটা ভাবাল এই প্রদর্শনী।’’

প্রদর্শনী সাজিয়ে তোলায় যুক্ত, অন্যতম শিল্পী সুমন্ত্র মুখোপাধ্যায় জানান, কাজ করতে গিয়ে তথাকথিত রোগীরা তাঁকে অন্য রকম যাপনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। এক জন জানিয়েছেন, মালা ছাড়াই বিয়ে হয়েছিল তাঁর। সামাজিক রীতিতে যা প্রয়োজনীয়, তার অভাব দু’টি মানুষের অঙ্গীকারে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তিনি জানাচ্ছেন, এই সব টুকরো টুকরো কাহিনি চলতি সামাজিক মাপকাঠিতে স্বাভাবিক নয়, চাকচিক্যবিহীনও বটে। দামি বিপণিতে সাজানো শপিং মলে এই চরম বৈপরীত্যই ভাবতে শেখায় বিভিন্ন ধরনের যাপন নিয়ে। প্রদর্শনী ঘুরে দেখতে দেখতে তাই অধ্যাপক কল্যাণ রায় প্রশ্ন রেখে যান, ‘‘যাঁদের আমরা প্রতিবন্ধী বলে দূরে ঠেলে রাখি, তাঁদের কথা যে আমরা ভাবি না, শুনি না, সেটা কি আসলে আমাদেরই একটা প্রতিবন্ধকতা নয়?’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Psychology Mental Patient

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy