একুশের বিধানসভা ভোটে 'বহিরাগত' কাঁটায় বিদ্ধ হয়েছিল গেরুয়া শিবির। ছাব্বিশের ভোটে সেই ভুল আর করতে চাইছে না তারা। তাই আগেভাগেই মেপে পা ফেলছে। চেষ্টা করছে বাঙালি আবেগ ছুঁতে। সেই সূত্রেই এ বার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের 'ধন ধান্য পুষ্পে ভরা' ও অতুলপ্রসাদ সেনের 'হও ধরমেতে ধীর' গানকে সামনে রাখতে চাইছে সঙ্ঘ পরিবার।
মুর্শিদাবাদের অশান্তি এবং তার পরে কাশ্মীরে জঙ্গি হানার পরে বাংলার বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলিকে এক ছাতার তলায় আনার চেষ্টা করছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)। ঝাড়গ্রামে চারটি বিধানসভা এলাকাকে নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ‘জঙ্গলমহল হিন্দু সুরক্ষা বাহিনী’। গোটা রাজ্য জুড়ে গড়ে উঠেছে বঙ্গীয় হিন্দু সুরক্ষা মঞ্চ। তাতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, হিন্দু জাগরণ মঞ্চ, বজরং দলের সঙ্গে আঞ্চলিক ভিত্তিতে গড়ে উঠা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলিকেও রাখা হয়েছে। স্বয়ংসেবকদের দাবি, এই অস্থির পরিস্থিতিতে বাংলা ও বাঙালি হিন্দুকে ঐক্যবদ্ধ করতে কাজ করবে এই মঞ্চ। বেছে নেওয়া হয়েছে এমন দু’টি গানকে যা শুধু স্বাদেশিকতার প্রেরণা দেয় তাই নয়, সাধারণ বাঙালিকে আবেগেও ভাসায়। অনেকে মনে করাচ্ছেন, এই গান দু’টি আগে অনেক স্কুলে প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। কয়েকটি স্কুলে এখনও হয়। তাই সমাজের সব স্তরেই এই গান দু’টির পরিচিতি রয়েছে।
বঙ্গীয় হিন্দু সুরক্ষা মঞ্চ সমবেত সঙ্গীত হিসেবে ‘ধন ধান্য পুষ্পে ভরা’ ও ‘হও ধরমেতে ধীর’ গান দু’টি গাইতেও শুরু করেছে। রবিবার সন্ধ্যায় ওই সংগঠনের ডাকে কাশ্মীরে জঙ্গি হানায় নিহতদের শ্রদ্ধা জানানোর কর্মসূচিতে সমবেত সঙ্গীত হিসাবে গাওয়া হয় এই দুই গান। ওই সংগঠনের নেতৃত্ব জানিয়েছেন, এ বার থেকে তাঁদের সব কর্মসূচিতেই এই দুই গান গাওয়া হবে। উল্লেখ্য, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ‘ধন ধান্য পুষ্পে ভরা’ গানটি লেখেন ১৯০৫ সালে। সুরও দেন তিনি। তখন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন আছড়ে পড়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে লেখা এই গান বাঙালির স্বাদেশিকতার আবেগকে জাগিয়ে গিয়েছিল। পরে দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর ‘শাহজাহান’ নাটকেও এই গানটি অন্তর্ভুক্ত করেন। নাটকের একটি দৃশ্যে কারারুদ্ধ শাহজাহানকে এই গান গাইতে দেখা যায়। আবার অতুলপ্রসাদ সেন ‘হও ধরমেতে ধীর’ গানটি লেখেন ১৯২৫-২৬ সাল নাগাদ।
ব্রিটিশ শাসকের বিভাজনের বিরুদ্ধে ঐক্যের সুর তোলা এই দুই গানকে কেন বাছল সঙ্ঘ পরিবার? বঙ্গীয় হিন্দু সুরক্ষা মঞ্চের অন্যতম এক মুখ তথা আরএসএসের এক কার্যবাহ বলছেন, ‘‘বাংলা ও বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করা এখন খুব জরুরি। তাই ঐকের সুর বাঁধতে এই দুই গান বাছা হয়েছে। যাতে স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে পারি আমরা।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘সমগ্র হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। বাংলার হিন্দুদের সুরক্ষার মন্ত্র হিসাবে কাজ করবে ওই গান দু’টি।’’ বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক নীলকমল পাল বলেন, ‘‘বাংলার বিবেককে জাগ্রত করার জন্য মাতৃভাষায় দেশাত্মবোধক এই দু’টি গানকে রাখা হয়েছে। বাঙালি হিন্দু আজ স্বাধীন হয়েও যেন পরাধীন। বঙ্গভঙ্গের সময় যেমন বাংলা ও বাঙালির ঐক্য ফুটে উঠেছিল, এখন তেমনই ঐক্য চাই তাঁদের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে।’’
কয়েকমাস আগে রাজ্য সঙ্গীত হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানকে বেছে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ঘটনাচক্রে এই গানটিও লেখা হয় ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। সেই কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে তৃণমূল। দলের জেলা সভাপতি সুজয় হাজরার দাবি, ‘‘বিজেপি ও তার সহযোগীরা তো বাংলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতির বিরোধী। তারা বাংলা বিরোধী। এসব গান গেয়ে বাংলার মানুষকে তারা ভোলাতে পারবে না।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)