পিংলার বেলুরিয়ায় এই পুকুরের জল দেখেই কারচুপি ধরেছিলেন কেন্দ্রীয় দলের সদস্যরা। বর্ষায় অবশ্য পুকুর এখন প্রায় দিঘি। — কিংশুক আইচ।
পুকুরের জলের রং দেখেই প্রথম সন্দেহটা হয়েছিল। জলের রং গাঢ় সবুজ। অথচ, সদ্য খনন হওয়া পুকুরের জলের রং প্রথমে আকাশনীল বা ঘোলাটে হওয়ার কথা। তারপর ক্রমে তার রং হয় হালকা থেকে গাঢ় সবুজ।
তাহলে কি পুকুর আগেও খনন করা হয়েছে! কাগজপত্র দেখে দিল্লি থেকে আসা পরিদর্শক দলের সন্দেহই সত্যি হল। জানা গেল, এই একই পুকুর গত বছরও খনন করা হয়েছিল।
একশো দিনের কাজ প্রকল্পে কারচুপির অভিযোগ নতুন নয়। তবে এ ভাবে পুকুরের জলের রং দেখে কেন্দ্রীয় পরিদর্শক দলের হাতেনাতে কারচুপি ধরে ফেলার মতো ঘটনা সচরাচর হয় না। এ বার সেটাই হয়েছে। সম্প্রতি রাজ্যের বিভিন্ন জেলা ঘুরে রিপোর্ট দিয়েছে কেন্দ্রের পরিদর্শক দল। তাদের পর্যবেক্ষণ, রাজ্যে একশো দিনের প্রকল্পে পুকুর খননে কারচুপি চলছে। একই পুকুর একাধিকবার খনন করা হয়েছে বলে দেখানো হচ্ছে। বারবার খননের টাকা খরচের খাতায় উঠে যাচ্ছে।
প্রশাসন সূত্রে খবর, রিপোর্ট পাঠিয়ে রাজ্যকে এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রের দল। প্রশাসনের এক কর্তা মানছেন, “দিল্লি থেকে রিপোর্ট এসেছে। একশো দিনের প্রকল্পে ঘাটতির কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে পুকুর খননে।”
গত মে মাসের শেষে রাজ্যে এসেছিল কেন্দ্রের গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের পরিদর্শক দল। জুনের প্রথম দিক পর্যন্ত দলটি রাজ্যে ছিল। একাধিক জেলায় ঘোরেন পরিদর্শকরা। পশ্চিম মেদিনীপুরেও পাঁচ সদস্যের একটি দল এসেছিল। একাধিক ব্লকে ঘুরে একশো দিনের কাজ কেমন চলছে তা দেখেন দিল্লির ওই প্রতিনিধিরা। পরিদর্শকরা এসেছিলেন পিংলার জলচক-১ পঞ্চায়েত এলাকায়। জেলার যে কয়েকটি পঞ্চায়েত এই প্রকল্পে খুব বেশি টাকা খরচ করেছে, এটি তার অন্যতম। ২০১৫-’১৬ সালে এই পঞ্চায়েত খরচ করেছে ৪ কোটি ৪৮ লক্ষ টাকা।
এখানকার বেলুরিয়ায় পুকুর খনন দেখতে গিয়েই ধরা পড়ে গরমিল। কাগজপত্র ঘেঁটে পরিদর্শকরা দেখেন, মাস দুয়েক আগে এই পুকুর খনন করা হয়েছে। তবে জলের রং দেখে সন্দেহ হয়। ধরা পড়ে কারচুপি। জানা গিয়েছে, ২০১৪-’১৫ সালে খননের সময় খাতায়-কলমে দেখানো হয়েছিল পুকুরটি নিমাই মণ্ডলের। আর ২০১৫-’১৬ সালে খননের সময় দেখানো হয়েছে পুকুরের মালিক প্রসেনজিৎ মণ্ডল। নিমাইবাবুরই ছেলে প্রসেনজিৎ।
পিংলার বরিষা থেকে চণ্ডীয়া নদীর বাঁধ বরাবর কিছুটা গেলেই বেলুরিয়া। এখন বর্ষার জলে টইটুম্বুর পুকুর দিঘির আকার নিয়েছে। তবে একাধিকবার পুকুর খননের কথা মানলেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য তৃণমূলের পিউ মণ্ডল। তাঁর যুক্তি, “পুকুরটা বেশ বড়। তাই দু’বার সংস্কার কাজ করতে হয়েছে!” সঙ্গে যোগ করছেন, “দু’বারই কিন্তু কাজ হয়েছে!” কিন্তু দিল্লির দল যে কারচুপি ধরে ফেলেছে? জলচক-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান অজিত দাসের জবাব, “এটা কারচুপি নয়। কিছু কাগজপত্র, কাজের আগে-পরের কিছু ছবি ওঁরা দেখতে চেয়েছিলেন। তখন দেখানো যায়নি।” গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে অবশ্য বোঝা গেল, একই পুকুর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে খনন করাটাই মোটামুটি দস্তুরে দাঁড়িয়েছে। বেলুরিয়ার শুভাশিস মাইতি, তাপসী মিশ্রদের কথায়, “একশো দিনের কাজে মাটি খোঁড়ার কাজ তো মাঝেমধ্যেই হয়। একই পুকুর বারবার খোঁড়া হয়। এ আর নতুন কী!”
প্রশাসনের এক সূত্রে খবর, শুধু একই পুকুর বারবার সংস্কার দেখানো নয়, পরিদর্শক দলের রিপোর্টে আরও কিছু গরমিলের উল্লেখ রয়েছে। খড়্গপুর-২ ব্লকের লছমাপুর পঞ্চায়েতে মাস্টার রোলে প্রচুর কাটাকাটি, নিয়ম না-মেনে জিনিসপত্র কেনা, নারায়ণগড়ের পাকুড়সেনি পঞ্চায়েতে দরপত্রে দুর্নীতি ধরেছে কেন্দ্রীয় দল। দেখা গিয়েছে, একজনই তিনটি দরপত্র জমা দিয়েছে। তিনটিতে হাতের লেখাও এক। আরও পর্যবেক্ষণ, প্রকল্পের ডিসপ্লে বোর্ড কেনার ক্ষেত্রে অসঙ্গতি রয়েছে। কোথাও ১,৮০০ টাকায় বোর্ড কেনা হয়েছে, কোথাও তিন হাজার টাকায়। কাজ চলাকালীন এবং কাজের পরে এই তিন দফার ছবিও তুলে রাখা হয়নি। পরিদর্শনের সময় একটি ৬০০ মিটার কংক্রিট ঢালাই রাস্তার কাজ নজরে এসেছে। বাস্তবে এই রাস্তার দু’প্রান্তে কাজ হয়েছে। অথচ দেখানো হয়েছে কাজ হয়েছে গোটা রাস্তার।
কেন্দ্রের পরিদর্শক দলের রিপোর্ট পেয়ে এ বার নড়েচড়ে বসেছে রাজ্য। কারণ রাজ্য কী পদক্ষেপ করছে, তা জানাতে বলা হয়েছে দিল্লিতে। পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনাও বলেন, “রিপোর্ট এসেছে। রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy