মশারি দিয়ে ধরা হচ্ছে মাছ। বেলপাহাড়িতে তোলা নিজস্ব চিত্র।
ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। জামবনির রাস্তার ধারের জলা জমিতে মশারি দিয়ে মাছ ধরছিলেন ভূতু শবর, লুলক্যা শবররা। মশারি দিয়ে মাছ ধরার ছবি নতুন কিছু নয়। কিন্তু, অবাক হওয়ার বিষয় হল ওই মশারি তাঁরা পেয়েছিলেন স্বাস্থ্য দফতর থেকে! মশারি টাঙিয়ে ঘুমনোর তো অভ্যেস নেই। তাই মাছ ধরতে কাজে লাগানো হয়েছে ওই মশারি।
দিন কয়েক আগেই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন জামবনির বাহিরগ্রামের বিজয়া বেরা (৪৮) নামে এক মহিলা। তারপরও জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত এলাকায় মশা বাহিত রোগ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সচেতন নন বাসিন্দারা। ভোরে মশা কামড়ালে ডেঙ্গি হতে পারে, সেটা জানেন না বাহিরগ্রামের দুলাল শবর, বুধু শবরদের মতো সিংহভাগ গ্রামবাসী। স্বাস্থ্য দফতরের তরফে কোনও প্রচারও নেই।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বাহিরগ্রাম থেকে নিকটবর্তী সরকারি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ৯ কিলোমিটার দূরে। আর গ্রাম থেকে ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালের দূরত্ব ২০ কিমি। তাই কেউ অসুস্থ হলে প্রথমে দেখান গ্রামের হাতুড়েকে। গত ২২ জুলাই জ্বর হওয়ার পরে বিজয়াদেবীকেও গ্রামের হাতুড়ের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল। জ্বর না সারায় ২৬ জুলাই ঝাড়গ্রামের একটি নার্সিংহোমে বিজয়াদেবীকে ভর্তি করেছিলেন পরিজনরা। জ্বর ভাল না হওয়ায় সেখান থেকে বিজয়াদেবীকে মেদিনীপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের ভর্তি করানো হয়। সেখানে রক্ত পরীক্ষায় বিজয়াদেবীর ডেঙ্গি ধরা পড়ে। ২৯ জুলাই সকালে বিজয়াদেবীকে কলকাতায় রেফার করে দেন ওই বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ওই দিনই দুপুর পৌনে ১২ টা নাগাদ বিজয়াদেবীকে এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। দুপুর সোয়া ১২ টা নাগাদ তাঁর মৃত্যু হয়।
ডেঙ্গি হয়েছে কি না একমাত্র রক্তের এলাইজা টেস্টে জানা যায়। অথচ ঝাড়গ্রাম স্বাস্থ্য জেলার ৮টি ব্লকের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই টেস্টের ব্যবস্থা নেই। একই ছবি গ্রামীণ ও সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এবং ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালেও। ভরসা বলতে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং মেদিনীপুরের হাতে গোনা এক-দু’টি বেসরকারি নির্ণয় কেন্দ্র।
বৃহস্পতিবার সকালে জামবনি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সমীর ধল বাহিরগ্রামে যান। তিনি গ্রামবাসীদের ডেঙ্গি সম্পর্কে সচেতন করেন। জ্বর হলে সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার জন্য গ্রামবাসীদের আবেদন জানান। কেন বিজয়াদেবীকে প্রথমে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়নি সেই প্রশ্নও তোলেন সমীরবাবু। গ্রামবাসী সমীরবাবুর কাছে অভিযোগ করেন, স্বাস্থ্য দফতর মশা মারার স্প্রে করে না। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, গ্রামের কয়েকজন জ্বরে আক্রান্ত। আরও বেশ কয়েকজন সদ্য জ্বর থেকে সেরে উঠেছেন। বিজয়াদেবীর মৃত্যুর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতে বৃহস্পতিবার জামবনি ব্লক স্বাস্থ্য দফতরের উদ্যোগে শিবির করে ৫৮ জন বাসিন্দার রক্তের স্লাইড সংগ্রহ করা হয়। সেগুলি পরীক্ষার জন্য মেদিনীপুরে
পাঠানো হবে।
গ্রামবাসী বছর পঞ্চাশের রবি নায়েক, পাঁচ বছরের শিশু মৌমিতা মণ্ডলদের মতো অনেকের জ্বর হয়েছে। মৌমিতার বাবা লক্ষ্মণ মণ্ডলের বক্তব্য, সরকারি হাসপাতালে ভাল করে দেখা হয় না। তাই আমরা হাতুড়ের কাছে চিকিৎসা করাই।’’ কিন্তু স্বাস্থ্য দফতরের দেওয়ার মশারি টাঙিয়ে শোন না কে? হেসে ভূতু শবরের উত্তর, ‘‘ওতে দম বন্ধ হয়ে আসে। ঘুম হয় না।’’
তবে আশ্বাসের কথা শোনাচ্ছেন ঝাড়গ্রামের সিএমওএইচ অশ্বিনী মাঝি। তিনি জানান, জ্বর হলে নিকটবর্তী সরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে। মেদিনীপুর মেডিক্যালে রক্তের নমুনা পাঠিয়ে ডেঙ্গির এলাইজা টেস্ট করানো হয়। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। জমা জল নিয়মিত ফেলতে হবে। মশারি ব্যবহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে ডেঙ্গির থেকে ম্যালেরিয়াও কিন্তু ভয়ঙ্কর। তাঁর দাবি, ‘‘ডেঙ্গি ও ম্যালেরিয়া নিয়ে নিয়মিত ট্যাবলো গাড়ি এলাকায় ঘুরছে। কিন্তু বাসিন্দারা নিজেরা সচেতন হচ্ছেন না। আমরা মশারি দিচ্ছি। সেই মশারিতে ওঁরা মাছ ধরছেন!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy