Advertisement
E-Paper

দ্বিতীয় ও পঞ্চমের পরে জল, ছ’য়ের শেষে ফল

‘বাজল ছুটির ঘণ্টা’র দিকে নয়, কান পাততে হবে জল-ফলের ঘণ্টায়। না হলে পুষ্টি ও অন্য শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ ব্যাহত হবে। সাম্প্রতিক চর্চার বিষয়টি স্কুলে জলের ঘণ্টা। জেলার একটি স্কুলে দু’দশকের বেশি সময়ে ঘণ্টা ধরে জল পানের নিয়ম রয়েছে। খোঁজ নিল আনন্দবাজার

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:০০
অভ্যাস: ক্লাসে চলছে জল খাওয়ার বিরতি। গড়বেতার একটি স্কুলে। নিজস্ব চিত্র

অভ্যাস: ক্লাসে চলছে জল খাওয়ার বিরতি। গড়বেতার একটি স্কুলে। নিজস্ব চিত্র

খুব পুরনো বিজ্ঞাপন। আশির দশকের। বিজ্ঞাপনটি ছিল একটি জলের বোতল তৈরি সংস্থার। বিজ্ঞাপনে দেখানো হত, মা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর সময়ে জলের বোতল দিচ্ছেন। কিন্তু দুই শিশু সেই বোতলে জল খেতে নারাজ। কারণ প্লাস্টিকের তৈরি ওই বোতলে জল রাখলে তা গন্ধ হয়ে যায়। বাচ্চারা জল খায় নাক টিপে।

আসলে বাচ্চারা নানা কারণে জল ও টিফিন খাওয়া এড়াতে চায়। পরিবর্তে স্কুলের কাছাকাছি বসা নানা মুখরোচক খাবারে আগ্রহ দেখায়। তাতে ক্ষতি হয় বাচ্চাদের। জলের সঙ্গে ফল খাওয়াও জরুরি। ফলেও রয়েছে প্রচুর জল। সঙ্গে পুষ্টিগুণ। সেই কারণেই বিভিন্ন রাজ্যের স্কুলে ফল খাওয়া ও জলপানের উপরে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, প্রতিটি ছাত্রের (শিশু) বিশুদ্ধ জল পান করার অধিকার রয়েছে। জল-ফলের গুরুত্ব জেলার পড়ুয়া এবং শিক্ষকদের কেউ কেউ বুঝেছেন।

আশিসকুমার মিদ্যা

জল ও ফল খাওয়ার অভ্যাস বাড়ির থেকেই হওয়া উচিত। অভিভাবকদের সচেতন হওয়া আগে জরুরি। জাঙ্ক ফুড, ঠান্ডা পানীয়, মুখরোচক খাবারে ছেলে মেয়েরা যাতে আসক্ত না হয় তা প্রথম থেকেই দেখতে হবে অভিভাবকদের। এখন তো পড়ুয়াদের জল ও ফল খাওয়ার অভ্যাস কমে যাচ্ছে। অনেক ছেলে মেয়ে তো কোনও ফলই খায় না। পড়াশোনার চাপ বাড়ছে, প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। এখনই খাওয়াদাওয়ার সুঅভ্যাস গড়ে তোলা চাই। তাছাড়া জল ও ফল না খেলে শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। জল জীবনের একটা অঙ্গ। পড়ুয়াদের সারা দিনে কম করে ৩ লিটার জল খাওয়া দরকার। খেলাধুলো করলে আরও বেশি। গ্রীষ্মে তো বেশি জল খেতেই হয়। ভিটামিন, প্রোটিন, সুষম খাদ্যও দরকার। দুধ, ডিম, মাছ, মাংসের সঙ্গে ফলমূলও দরকার। বাচ্চারা অনেকটা সময় স্কুলে কাটায়। তাই স্কুলেই তাদের জল ও ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার। অন্যান্য রাজ্যে এটা হচ্ছে বলে শুনেছি।

মেডিক্যাল অফিসার, গড়বেতা গ্রামীণ হাসপাতাল

মামন সিদ্ধান্ত

আমাদের মতো অনেকেরই জাঙ্ক ফুডে আগ্রহ আছে। মোগলাই, চাউমিন, ঠান্ডা পানীয়ের মোহ অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীদেরই। সেই অভ্যাস কাটাতে আমাদের স্কুলে জল ও ফল খাওয়ার বিরতি চালু হয়েছে। একমাস হল আমাদের প্রতিটি শ্রেণিতে দ্বিতীয় ও পঞ্চম পিরিয়ড হওয়ার পর জল খাওয়ার বিরতি হচ্ছে। ষষ্ঠ পিরিয়ডের পর ফল খাওয়ার বিরতি। আমাদের অভিভাবকদেরও এই রুটিন জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা নিয়মিত এখন জল ও ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলছি। এতে ভিটামিন, মিনারেল যেমন পাওয়া যাচ্ছে, তেমনই শরীরে জলের প্রয়োজনীয়তাও মিটছে। স্কুলের ম্যাম, স্যারেরা আমাদের গাইড করছেন, আমার মতে অন্যান্য স্কুলেও এই নিয়ম চালু করা দরকার।

দশম শ্রেণি, সেন্ট নিকোলাস পাবলিক স্কুল, গড়বেতা

অনুপম নায়েক

অপুষ্টিজনিত রোগ, ডিহাইড্রেশন, প্রস্রাব সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দেয় জাঙ্ক ফুডে। রোগ থেকে রেহাই পেতে শিশু ও কিশোর শিক্ষার্থীদের জাঙ্ক ফুড খাওয়ার প্রবণতা কমাতে হবে। এটা কমতে পারে কিছু অভ্যাসের মধ্য দিয়ে। ইতিমধ্যে কেরল, কর্নাটকে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জল ও ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে। ওড়িশা, মহারাষ্ট্রেও চেষ্টা চলছে। আমাদের রাজ্যেও এই ভাবনা চলে এসেছে। গড়বেতার প্রত্যন্ত এলাকার এই স্কুলে আমরা নভেম্বর মাস থেকেই প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ‘ওয়াটার অ্যান্ড ফ্রুট ব্রেক’ চালু করেছি। যাতে শিশু ও কিশোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে জল ও ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠে। এ নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে বৈঠকও করেছি, প্রত্যেকের বাড়িতে নোটিসও পাঠিয়েছি। অভিভাবকদের বলেছি ছেলে মেয়েদের কাটা নয়, সবধরনের গোটা ফল দিতে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা প্রতি শ্রেণিতে এই বিষয়টি নিয়মিত মনিটরিং করছেন। আশা করি, কয়েক মাসের মধ্যেই ছাত্রছাত্রীদের সুঅভ্যাস গড়ে তুলতে পারব।

অধ্যক্ষ, সেন্ট নিকোলাস পাবলিক স্কুল (সিবিএসই অনুমোদিত), গড়বেতা

ঝাড়গ্রাম জেলা শিক্ষা দফতরের এক আধিকারিক জানালেন, প্রাথমিক স্কুলগুলিতে পড়ুয়াদের নিয়মিত জল খাওয়ানোর কথা বলা হয়। পানীয় জলের বন্দোবস্তও রয়েছে। পড়ুয়াদের অনেকে বাড়ি থেকেও জল নিয়ে আসে। মিড ডে মিল খাওয়ার কিছুক্ষণ পরে পড়ুয়ারা জল খাচ্ছে কি-না দেখার জন্য শিক্ষকদের নজর দিতে বলা হয়। ঝাড়গ্রামের জোয়ালভাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহশিক্ষক সন্দীপ করণ বলেন, ‘‘ক্লাস চলাকালীন খুদে পড়ুয়াদের জলের বোতল শ্রেণিকক্ষের একদিকে রাখা থাকে। আমরা পাঁচ মিনিট করে দিনে ৩-৪ বার ‘ওয়াটার ব্রেক’ দিয়ে থাকি।’’ ঝাড়গ্রাম শহরের সরকারি জঙ্গলখাস ইরেজি মাধ্যম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহ-শিক্ষক সুদীপ্ত নায়েক বলেন, পড়ুয়াদের তেষ্টার দিকে নজর রাখা হয়। তারা নিয়মিত জল পান করছে কি-না সেটা আমরা লক্ষ্য রাখি।’’ এর বাইরে বেশির ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়াটার ব্রেকের কোনও ব্যবস্থা নেই। বেলপাহাড়ির এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলছেন, ‘‘স্কুলের মাত্র দু’জন শিক্ষক। পড়ুয়া শতাধিক। সব দিকে এভাবে নজর দেওয়া সম্ভব নয়।’’

ফল ও জল খাওয়ার গুরুত্ব বোঝাতে সম্প্রতি স্কুলে চালু হয়েছে ঘণ্টা। কিন্তু জল খাওয়ার কড়াকড়ি বহু আগে থেকেই রয়েছে নন্দকুমারের ব্যবত্তারহাটে মণ্টেসরি মডেল ইনস্টিটিউশনে। বেসরকারি এই স্কুলটি ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠাতা-প্রধান শিক্ষক পঞ্চানন মাইতি। স্কুলের নিয়ম শৃঙ্খলা বেশ কড়া। সে কথা বলেন অভিভাবকেরাই। স্কুল স্থাপনের সঙ্গেই ছাত্র ছাত্রীদের স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ নজর দেন প্রধান শিক্ষক। স্কুলে জাঙ্ক ফুড আনা একেবারেই নিষিদ্ধ। অভিভাবকদের প্রায়ই বলতে শোনা যায়, তাঁদের বাড়ির ছেলে মেয়েরা স্কুলে জল খায় না বা কম খায়। অনেক পড়ুয়াকে প্রায়ই ভর্তি জলের বোতল বাড়ি ফেরত নিয়ে যেতে দেখা যায়। ব্যবত্তারহাটের স্কুলটি কিন্তু ২৮ বছর ধরে জল খাওয়ার নির্দিষ্ট রুটিন পালন করে চলেছে। প্রতিটি ক্লাসের শেষে ছাত্র ছাত্রীদের প্রয়োজন মতো জল খেতেই হবে। টিফিনের মধ্যে জলের বোতল অবশ্যই শেষ করতে হবে। টিফিনে ফের বোতল ভরে নিতে হবে। ছুটির মধ্যে সেটি শেষ করে বাড়ি যেতে হবে। প্রধান শিক্ষকের কথায়, ‘‘ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা জল খাওয়ায় প্রায়ই অনীহা দেখায়। আমাদের স্কুলে ৭০০ জন পড়ুয়া। স্কুলে জল খাওয়ার নির্দিষ্ট রুটিন রয়েছে। ছাত্র ছাত্রীরা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অভিভাবকেরাও খুশি।’’ এই স্কুলে খাওয়ার আগে হাত ধোয়া বাধ্যতামূলক। শিক্ষক শিক্ষিকারা এই বিষয়ে বিশেষ নজর দেন।

দুধে ভাতে থাকলে সন্তানেরা সুখে থাকবে। কিন্তু সে তো মধ্যযুগের ধারণা। জল-ফলে শিশুদের সুস্থ রাখার চেষ্টা এ যুগে। চেষ্টা জলে যাবে না। ফল ফলবেই। আশা অভিভাবক, শিক্ষকদের।

তথ্য সহায়তা: রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য, দিগন্ত মান্না, কিংশুক গুপ্ত

UN Doctrine Break to drink water Water Children Diet
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy