Advertisement
E-Paper

মদই খেয়েছে ওদের, ভুগছে পরিবার

এ-পুকুর, সে-পুকুর ঢুঁড়ে আঁচলে বেঁধে নেন কয়েকটা গেড়ি গুগলি। তারপর বাজারে সেই গুগলি ছাড়িয়ে দু’একটা টাকা যা পাওয়া যায় তা দিয়েই জুটে যায় রাতের খাবার। না একটা পেটের অন্ন নয়, বাড়িতে আছে তিন বৌমা, নাতি-নাতনিরা। তাই শীত যতই বাড়ুক পুকুরে নামতে কুণ্ঠা করেন না বছর ষাটেকের শেফালি জাঙ্গাল। কোনও উপন্যাসের ছবি নয়।

অভিজিৎ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:১২
লক্ষ্মী মালিক (বাঁ দিকে), স্মৃতি আঁকড়ে শেফালি জাঙ্গাল (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র।

লক্ষ্মী মালিক (বাঁ দিকে), স্মৃতি আঁকড়ে শেফালি জাঙ্গাল (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র।

এ-পুকুর, সে-পুকুর ঢুঁড়ে আঁচলে বেঁধে নেন কয়েকটা গেড়ি গুগলি। তারপর বাজারে সেই গুগলি ছাড়িয়ে দু’একটা টাকা যা পাওয়া যায় তা দিয়েই জুটে যায় রাতের খাবার। না একটা পেটের অন্ন নয়, বাড়িতে আছে তিন বৌমা, নাতি-নাতনিরা। তাই শীত যতই বাড়ুক পুকুরে নামতে কুণ্ঠা করেন না বছর ষাটেকের শেফালি জাঙ্গাল। কোনও উপন্যাসের ছবি নয়। রীতিমতো বাস্তব। তিন ছেলেকে শেফালিদেবী হারিয়েছেন মদের জন্য।

ঘাটাল তিন নম্বর ওয়ার্ডের কৃষ্ণনগর নতুন বাঁধপাড়ায় শেফালি জাঙ্গালের মতো চরিত্রের অভাব নেই। গল্পটা আরও একটু করুণ লক্ষ্মী মালিকের। ২২ বছর বয়সে স্বামীকে হারিয়েছেন। স্বামীর মদের নেশাই কাল হয়েছিল। ছোট ছোট দুই ছেলেকে মানুষ করেছেন একা। এখন পঞ্চাশের কোঠায় দাঁড়িয়ে ঝাপসা চোখে দেখেন ছোট ছেলে শিবনাথও একই ভাবে পাড়ার চোলাইয়ের দোকান থেকে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে।

চোলাই মদের প্রকোপে শুধু অকাল মৃত্যুই নয়। জেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামে বহু যুবক অসুস্থ হয়ে পড়ে রয়েছেন। তাঁদের শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা জটিল রোগে। নেশাগ্রস্তের তেমন রোজগার নেই। ফলে সঠিক চিকিৎসাও হয় না। ঘাটালের মনসুকার সুকান্ত কাপাস, কুঠিঘাটের অভয় সরকার, দাসপুরের নাড়াজোলের শ্রীমন্ত দোলুইয়েরা কেউ প্যানক্রিয়াটাইটিস, কেউ অস্টিও ম্যানেশিয়ার মতো রোগের আক্রান্ত।

ঘাটাল মহকুমার দাসপুরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মাঝে মধ্যেই চোলাই মদ না-খাওয়ার জন্য সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করে। সংস্থার কর্ণধার নারায়ণ ভাইয়ের কথায়, “আমাদের হিসাব অনুযায়ী চোলাই মদ খেয়ে গত পাঁচ বছরে আনুমানিক শ’তিনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে আড়াইশোর বেশি বছর তিরিশের যুবক। নানা জটিল রোগে আক্রান্ত অন্তত এক হাজার।’’ তাঁদের সচেতনতা মূলক প্রচারে মদের নেশা সাময়িক বন্ধ হয় বটে। কিন্তু পুরোপুরি মদ ছাড়ানো বেশ সমস্যার। প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন করে তৈরি হয় নেশা। নারায়ণ ভাইয়ের দাবি, “মদ বিক্রি করলে কড়া শাস্তি দিতে হবে। না হলে বছর পাঁচেকের মধ্যে বহু যুবকের মৃত্যু ঘটবেই।”

এ তথ্য যে সঠিক-তা টের পাওয়া যায় মহকুমার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে। চন্দ্রকোনা গ্রামীণ ও সোনাখালি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকরা জানালেন, “আউটডোরে প্রতিদিন অন্তত ২৫-৩০ জন রোগী আসেন, যাঁদের চোলাই খেয়ে পেটের, নার্ভের ও লিভারের সমস্যা। বেশিরভাগেরই বয়স পঁচিশের মধ্যে। এক চিকিৎসক বললেন, ‘‘অনেকে তো মদ খেয়েও হাসপাতালে আসে। আমরা বকাবকি করি। কিন্তু কে কার কথা শোনে!”

সূত্রের খবর, চোলাই মদ দিনের পর দিন পেটে পড়লেই হেফাটিক এনসেফ্যালোপ্যাথি, অস্টিও ম্যানেশিয়া, প্যানক্রিয়াটাইটিস, অপটিক নিউরাইটিস জন্ডিস, ক্যান্সার-সহ নানা রোগ হয়। খিদে কমে যাওয়া, বমি বমি ভাব, রক্ত ক্ষরণের প্রবণতা বৃদ্ধি, হাড় নরম হয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট সবই হতে পারে। ঘাটাল মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসক হরেকৃষ্ণ পাল বলেন, “চোলাই খেয়ে কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসা করে সুস্থ করা যায়। তবে শরীরের কর্মক্ষমতা অনেকটাই কমে যায়।’’ চিকিৎসা শুরু আগেই মদ পুরো ছেড়ে দিতে হয়। না হলে ফের রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা থেকে যায়। তখন আরও সমস্যায় পড়ে রোগীরা।

ঘাটালের মহকুমাশাসক যতীন্দ্রবিমল কর অবশ্য জানিয়েছেন, “চোলাই মদ বেআইনি। তাই এটা বন্ধ করতে লাগাতার অভিযান শুরু হবে।হবে সচেতনতা শিবিরও।” কিন্তু সে সব অভিযান যে তেমন কিছু উপকার করতে পারে না, তা বোঝা যায় লক্ষ্মীদেবীর কথায়।

তিন দশক আগে তাঁর স্বামী যখন মারা যান তখন অসহ্য পেটের সন্ত্রনা হত। বছর সাতাশের যুবক চোখেও দেখতে পেত না তেমন স্পষ্ট। প্রথম প্রথম বুঝতে না-পারলেও পরে সব বুঝেছিলেন লক্ষ্মীদেবী। বহু কষ্টে দুই ছেলেকে বড় করেছেন। তাঁর আক্ষেপ, “ছেলেদের কত করে বুঝিয়েছি। বড় ছেলে মেঘনাদ মদ ছোঁয় না।’’ ছোট ছেলে শিবনাথ মাত্র ২১ বছরেই মদ ধরেছে। ‘‘এখন সকাল হলেই মদ খেয়ে কাজে যায়। বকাবকি করলে বৌকে মারধরও করে। কী করব?” আক্ষেপ ছাড়া আর কিছু নেই লক্ষ্মীদেবীর।

illegal liquor
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy