কালীপুজোর সন্ধে। মেদিনীপুর শহরের হবিবপুরে তখন বেশ ভিড়। আশপাশে বেশ কয়েকটি সর্বজনীন শ্যামাপুজো হয়। একাধিক কালীমন্দিরও রয়েছে। আচমকাই কিছু যুবক রাস্তায় এসে দোদোমা ফাটাতে শুরু করল। ভয়ে তখন ছত্রভঙ্গ পুজোর ভিড়। সামনে দাঁড়ানো এক পুলিশকর্মী শব্দবাজি ফাটাতে নিষেধ করলেন। ওই যুবকেরা বলল বটে, ‘‘আর ফাটাবো না’’, তবে খানিক পরে কিছুটা দূরে গিয়ে আবার সশব্দে বাজি ফাটালো তারা। পুলিশকর্মীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন।
ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিলেন অর্পিতা সামন্ত, রুনু দত্তরা। অর্পিতা বলছিলেন, ‘‘শব্দবাজি না কি নিষিদ্ধ। শহরে তো দেদার বাজি ফাটছে। পুলিশও অসহায়।’’ শহরের প্রবীণ বাসিন্দা অতনু সাহারও বক্তব্য, ‘‘নিষিদ্ধ শব্দবাজির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়া উচিত ছিল অনেক আগে থেকে। সেটা দেরিতে হয়েছে। ততদিনে নিষিদ্ধ শব্দবাজি লোকের হাতে পৌঁছে গিয়েছে।’’
নিয়মমতো হাসপাতালের মতো এলাকায় শব্দের সীমা ৪০ ডেসিবেলের আশপাশে, বসতি এলাকায় ৪৫ ডেসিবেল আর বাণিজ্যিক এলাকায় ৫৫ ডেসিবেলের আশপাশে থাকার কথা। শহরের একাংশ বাসিন্দার দাবি, শনি এবং রবিবার রাতে শহরের একাধিক এলাকায় শব্দের সীমা ৯০-১০০ ডেসিবেলও ছুঁয়ে ফেলে! রাত যত বেড়েছে, বাজির দাপট তত বেড়েছে। পুজো দেখতে বেরিয়ে কান ঝালাপালা হয়েছে অনেকের। মেদিনীপুর শহরের সব এলাকাতেই কমবেশি শব্দবাজি ফেটেছে শনিবার। তবে বল্লভপুর, নতুনবাজার, রাঙামাটি, বক্সীবাজার, হবিবপুর, কুইকোটা, পটনাবাজার, মানিকপুর, রাজাবাজার, কোতবাজার, নতুনবাজার, শরৎপল্লি, বিধাননগর প্রভৃতি এলাকায় শব্দবাজির দাপট ছিল বেশি।
কালীপুজোর সন্ধে থেকে শব্দবাজির দাপট দেখা গিয়েছে রেলশহর খড়্গপুরেও। অথচ এই শহরে এ বার প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের শব্দবাজি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। শহরবাসীর দাবি, অন্য বারের তুলনায় এ বার শব্দবাজি কম ফাটলেও খাতায়-কলমে রয়েছে গিয়ে নিষেধাজ্ঞা। কয়েকটি এলাকায় তো অবাধে নিষিদ্ধ শব্দবাজি ফাটাতে দেখা গিয়েছে কিশোর-যুবকদের। প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞার কথা যথাযথ প্রচার না হওয়ায় অনেকেই না জেনেই শব্দবাজি ফাটিয়েছেন। আবার অনেকে নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে শব্দবাজি ফাটিয়েছেন। খড়্গপুর পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৬ জনকে গ্রেফতারও করেছে বলে জানিয়েছে। অবশ্য সেই ধরপাকড়ে যে শব্দবাজিতে রাশ টানা যায়নি তার প্রমাণ, রবিবার দীপাবলির সন্ধেতেও বিভিন্ন এলাকায় সশব্দে বাজি ফেটেছে।
খড়্গপুর শহরের ইন্দা, সাঁজোয়াল, বুলবুলচটি, বিদ্যাসাগরপুর, ভবানীপুর, সুভাষপল্লি, শ্রীকৃষ্ণপুর, রাজগ্রাম, ভগবানপুর, কুমোরপাড়া, তালবাগিচা, আয়মা, ছোটট্যাংরা, সোনামুখি এলাকায় অবাধে শব্দবাজি ফেটেছে। সাঁজোয়ালের বাসিন্দা রেলকর্মী কৃশানু আচার্য বলেন, “কালীপুজোর রাতে শব্দবাজিতে প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞাকে যেন একটা প্রহসন মনে হয়েছে। এটা ঠিক মূল সড়কে পুলিশি নজরদারি থাকায় অনেকে সাহস পায়নি। তবে গলিপথে পুলিশি টহল প্রয়োজন ছিল।’’ সুভাষপল্লির বাসিন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ছাত্র সৌরভ চক্রবর্তীর আবার বক্তব্য, ‘‘গলিপথে পুলিশি নজরদারি পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতাও প্রয়োজন ছিল।’’
কালীপুজোর রাতে অবশ্য পুলিশকে পথে নামতে দেখা গিয়েছে। খড়্গপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েকজনকে আটক করে বিস্ফোরক আইনে মামলাও রুজু করেছে পুলিশ। কিন্তু তার পরেও বিদ্যাসাগরপুর, সুভাষপল্লি-সহ বিভিন্ন এলাকায় শব্দবাজি ফেটেছে। তবে ঝাপেটাপুর, বুলবুলচটি, মালঞ্চর মতো এলাকায় ধরপাকড়ের পরে শব্দবাজিতে রাশ টানা গিয়েছে। বুলবুলচটির বাসিন্দা বীরেন মাইতি বলছিলেন, “নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কীভাবে শব্দবাজি ঢুকল সেটা পুলিশের ভাবা উচিত।’’
পুলিশ অবশ্য শব্দদৈত্যের দাপটের কথা মানতে নারাজ। খড়্গপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিষেক গুপ্ত বলেন, “আমরা বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালাচ্ছি। কয়েকজনকে হাতেনাতে ধরা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’’ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের এক কর্তারও দাবি, “একাধিক পুলিশের দল শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে। তেমন কোনও অভিযোগও আসেনি। কিছু বাজি হয়তো ফেটেছে। তবে এ বার পরিস্থিতি তুলনায় ভাল ছিল।’’