Advertisement
E-Paper

রাজ দরবার থেকে রাষ্ট্রপতির অতিথি

সাইকেলে ঝাড়গ্রামের রাজবাড়িতে বেহালা বাজাতে যেতেন। বাবার নির্দেশ মেনে বয়স ৫০ পেরনোর আগে কাউকে বাজনা শেখাননি। অনুষ্ঠান করেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বাংলাদেশেও। বেহালাবাদক সুবোধ সেনের কথা শুনলেন দীপাঞ্জন মাহাত

শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৮ ০৭:৪০
অনুষ্ঠানে: বেহালা বাদনে মগ্ন সুবোধবাবু। নিজস্ব চিত্র

অনুষ্ঠানে: বেহালা বাদনে মগ্ন সুবোধবাবু। নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: ঝাড়গ্রামের শিল্প এবং সাংস্কৃতিক মহলে পরিচিত মুখ। এই অরণ্য শহরে কতদিন?

উত্তর: (ক্ষণিকের চিন্তা) ১৯৪৮ সালে। ভারত স্বাধীন হওয়ার এক বছর পরেই ওপার বাংলা (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) থেকে বাবার হাত ধরে চলে এসেছিলাম এই শহরে। তখন তো এখনকার মতো এত জাঁকজমক ছিল না শহরটার। চারপাশে ঘন শাল জঙ্গল। আর রেল স্টেশনে টিমটিম করে জ্বলত লন্ঠন।

প্রশ্ন: আপনার জন্ম বাংলাদেশের কোথায়? কোন সালে?

উত্তর: ময়মনসিংহে। ১৯৩৮ সালে। একান্নবর্তী পরিবার ছিল।

প্রশ্ন: যন্ত্র সঙ্গীত, বেহালা বাজানোর ঝোঁকটা হল কী করে?

উত্তর: আমাদের পরিবারের সঙ্গে গানবাজনা ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। হয়তো পেশাদার ভাবে নয়, কিন্তু বংশ পরম্পরায় তার চল ছিল। ঠাকুরদা রামসুন্দর সেন, বাবা প্রবোধ সেন বা আমি, সকলেই সেই ধারা বয়ে চলেছি।

প্রশ্ন: বেহালা বাজানোর হাতেখড়ি কি ময়মনসিংহেই? নাকি ঝাড়গ্রামে আসার পরে?

উত্তর: ময়মনসিংহে থাকার সময় আমার বয়স কম ছিল। হাতে কলমে হয়তো তেমন কিছু শিখিনি। কিন্তু শুনে শুনে শেখার ইচ্ছার বীজটা মনের মধ্যে পোঁতা হয়ে গিয়েছিল। ঝাড়গ্রামে এসে ননীবালা বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। বাবা বলেছিলেন, যা করবে ম্যাট্রিক পাশের পরে। তবে তার আগে বাড়ির সেতারে লুকিয়ে নিজের মতো করে বাজানোর চেষ্টা করতাম। কিন্তু ম্যাট্রিক পাশের পরেই আমার বেহালা বাজানোর হাতেখড়ি।

প্রশ্ন: প্রাথমিকভাবে তার মানে আপনার বাবা আপনার গুরু?

উত্তর: হ্যাঁ। আমরা সকলে ঝাড়গ্রামে থাকলেও বাবা সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে কাজের সূত্রে যেতেন। ফিরে এলে শিখতাম। ১৯৫৪ সালে ম্যাট্রিক পাশ করার পরে বাবা আমাকে বললেন, কী করতে চাও? পড়াশোনা না গানবাজনা? কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম, কিন্তু গানবাজনাকেও বেছে নিয়েছিলাম। তখন বাবা একটা পরামর্শ দিয়েছিলেন। উনি জানিয়েছিলেন, যদি গান গাও, তা হলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠস্বরে প্রভাব পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে যদি যন্ত্র সঙ্গীতকে বেছে নিই, তা হলে তা চিরদিনের সঙ্গী হয়ে থাকবে।

প্রশ্ন: তার মানে বাবা আপনাকে বেহালা বেছে নিতে বলেছিলেন?

উত্তর: বাবা গাইড করেছিলেন। যন্ত্র চার রকমের হয়। বোয়িং ইনস্ট্রুমেন্ট (বেহালা, এসরাজ, সারেঙ্গি), ব্লোয়িং ইনস্ট্রুমেন্ট (বাঁশি, হারমোনিয়াম), স্ট্রাইকিং ইনস্ট্রুমেন্ট (পিয়ানো, ব্যাঞ্জো), প্লাকিং ইনস্ট্রুমেন্ট (সেতার)। তো আমি বেহালা বেছে নিয়েছিলাম। বাবার কাছে তালিম নেওয়া শুরু করলাম। প্রথম আট বছর ওয়েস্টার্ন শিখতাম। সঙ্গে আধুনিক শিক্ষাও চলছিল। আধুনিক গানের সঙ্গে ছোটখাট অনুষ্ঠানেও বাজাতাম। (হাসতে হাসতে) কত আর বয়স হবে তখন আমার, দর্শকদের হাততালিও পেতাম।

প্রশ্ন: ওই সময় ষাটের দশকে ঝাড়গ্রামের মানুষের মধ্যে বেহালার মতো যন্ত্র সঙ্গীতকে বোঝার মানসিকতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল?

উত্তর: (জোর গলায়) হ্যাঁ। ঝাড়গ্রাম অরণ্য শহর হতে পারে। ছোট্ট জেলা হতে পারে। কিন্তু এখানে শিল্প ও সংস্কৃতি সচেতন মানুষের অভাব নেই। কত ভাল ভাল সাহিত্যিক, কবি রয়েছেন। আর শহরে শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হলেন ঝাড়গ্রামের রাজা নরসিংহ মল্লদেব। শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা যাতে বেশি করে হয়, সে জন্য উনিই তো শহরের বুকে ‘ডি এম হল’টি তৈরি করে দিয়েছিলেন। সে সময় থিয়েটার হতো। ব্যাক গ্রাউন্ড মিউজিক দিতাম। তখন ‘বাণীতীর্থ’, ‘পুনশ্চ’এর মতো দল ছিল। পরবর্তী সময়ে ‘পুনশ্চ’ দেশের বিভিন্ন প্রদেশে গিয়ে অনুষ্ঠান করেছে।

প্রশ্ন: রাজা নরসিংহ মল্লদেবের প্রসঙ্গে জানতে চাইব। আপনার সঙ্গে ওঁর পরিচয় কী ভাবে?

উত্তর: ১৯৬১ সাল থেকে ক্লাসিক্যাল বাজাতে শুরু করি। ওই সময় রাজা নরসিংহ মল্লদেব এক-দু’দিন পরপর বাবা এবং আমাকে নিজের দরবারে বাজানোর জন্য ডাকতেন। আমি বাবার সঙ্গে সাইকেলে চড়ে যেতাম রাজবাড়ি। ১৯৬১-১৯৬২ এই দু’বছর আমরা টানা রাজবাড়ি গিয়েছি। বাবা পিয়ানো বাজাতেন আর আমি বেহালা। সেই সময় রাজা ওঁর তিনটি বেহালার একটি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। সেটারও বয়স একশো ছাড়িয়ে গিয়েছে।

প্রশ্ন: বাবা ছাড়া আর কার কাছে শিখেছেন?

উত্তর: বাবার গুরুভাই পণ্ডিত রবীন ঘোষ। রবীন্দ্রভারতীর অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৬৫ সাল নাগাদ আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ওঁর কাছে টেকনিক্যাল জিনিসগুলি শিখেছি। রাজ কলেজের অধ্যক্ষ ফটিক চট্টোপাধ্যায়, উনি সেতার বাজাতেন। জ্যোতিরঞ্জন ভৌমিক, ওঁর কাছেও শিখেছি। উনি রবিশঙ্করের ছাত্র ছিলেন।

প্রশ্ন: নিজের শিক্ষাপর্বে কী ধরনের বাধা পেয়েছেন?

উত্তর: আর্থিক সমস্যা তো ছিলই। টিউশন, ওষুধের দোকানে কাজ, কী না করেছি। কিন্তু রেওয়াজ ছাড়িনি। পরে এসডিও অফিসে চাকরি পাই। ঘরে ভাইদের যাতে পড়াশোনায় অসুবিধা না হয়, সে জন্য অফিস শুরুর আগে এবং অফিসের শেষে ওখানে বসেই রেওয়াজ করেছি।

প্রশ্ন: বেহালা বাজানোকে কি কখনও পেশা হিসাবে দেখেছেন?

উত্তর: (দৃঢ় স্বরে) না। বেহালা আমার ভাললাগা, ভালবাসা। ওই যে বলে না প্যাশন, ঠিক সেটাই। আজ আমার ৮১ বছর বয়স। এত দিনে অনেক অনুষ্ঠান করেছি। কিন্তু কখনও তা পারিশ্রমিক নিয়ে নয়। আমার যে অনুষ্ঠান মন থেকে ভাল লেগেছে, সেখানে বাজাতে গিয়েছি। আমার কাছে ন’টি বেহালা রয়েছে। সবক’টি উপহার পাওয়া। বেশ কয়েকটি বেহালা প্রায় ৩০০-৪০০ বছরের পুরনো। কিন্তু সেগুলি এখনও নতুনের মতোই আমার কাছে সযত্নে রয়েছে।

প্রশ্ন: কোথায় কোথায় অনুষ্ঠান করেছেন?

উত্তর: ভারতের প্রায় সব রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠান করেছি। ত্রিপুরা, মাদুরাই-সহ দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায়। রাজস্থানে অনুষ্ঠানে গিয়েছি। সেখানে বিদেশি পর্যটকদের সামনে অনুষ্ঠান করেছি।

প্রশ্ন: স্মরণীয় অনুষ্ঠানের কথা বলুন।

উত্তর: বেশ কয়েকটি রয়েছে। ১৯৮০ সালে কলকাতার কলামন্দিরে আমজাদ আলির অনুষ্ঠান শোনার দু’বার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু টিকিট পাইনি। একটা অতৃপ্তি ছিল। ২০০৬ সালে তা মিটেছিল। ওই বছর কলামন্দিরেই আমার অনুষ্ঠান হয়। হৈমন্তী শুক্লা, নির্মলা মিশ্র-সহ আরও জ্ঞানীগুণী জনের সামনে বাজাই। ১৯৮০ সালের অতৃপ্তিটা দূর হয়েছিল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের আমন্ত্রণে আমরা বেশ কয়েকজন ১৯৯৬ সালে সেখানে গিয়েছিলাম। রাষ্ট্রপতি ভবনে আমাদের অাপ্যায়ন করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। এছাড়া, ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবে পারফর্ম করাও স্মরণীয়। স্মরণীয় অনুষ্ঠান বলতে আরও একটি দিনের কথা বলতে হয়। বিড়লা অ্যাকাডেমিতে জাদুকর পি সি সরকার (জুনিয়র) বাজনা শুনে জড়িয়ে ধরেছিলেন। পুরস্কার পেয়েছি, নাগরিক সম্মান পেয়েছি, ক্যাসেট বেরিয়েছে— কিন্তু এসবের থেকেও অনুষ্ঠান করতে গিয়ে স্মৃতিগুলিই আমার কাছে সবচেয়ে বড় সম্মান। জীবনের বড় প্রাপ্তি।

প্রশ্ন: বেহালা বাজানো ছাড়া অন্য কোনও শখ রয়েছে?

উত্তর: এক সময় গল্প, কবিতা লিখতাম। বাংলাদেশের কিছু পত্রিকায় বেরিয়েছে। কিন্তু সে সবের থেকে বেশি ভাল লাগে ‘সুর ও বাণী’ নিয়ে কাজ করা। কোনও একটি থিম নির্ভর চিত্র্যনাট্য তৈরি করে তাতে সুর দেওয়া। এ নিয়ে বহু অনুষ্ঠান করেছি।

প্রশ্ন: পরবর্তী প্রজন্ম সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? আপনি কি অন্যদের বেহালা বাজানো শেখান?

উত্তর: (হাসতে হাসতে) আমার বাবা বলেছিলেন, ৫০ বছরের আগে কাউকে শেখাতে যেও না। আগে নিজে ভাল করে শেখো। ৫০ বছরের পরে যাঁরা আমার কাছে শিখতে এসেছেন, শিখিয়েছি। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে সেই প্যাশন, ভাললাগা, ভালবাসা দেখতে পাই না। একটা উদাহরণ দিই— আমার এক ‘শিষ্য’ রয়েছে কাশ্মীরে। ঝাড়গ্রামে ব্যবসার সূত্রে আসে ও। এখনকার প্রজন্মের বেহালা বাজানো নিয়ে ও বলেছিল, ‘‘আব বহত লোগোকে অন্দর ভায়োলিন শিখনে কা বুখার চড় গ্যায়া।’’ কিন্তু কয়েক মাস শিখেই সেই ‘বুখার’ কমে যায়। আমার কাছে যাঁরা শিখতে এসেছেন অধিকাংশের মধ্যেই ওই বেহালা শেখার ‘বুখার’টা সাময়িক। অনেকেই ভাবেন পড়াশোনার সঙ্গে গানবাজনা হয় না। কিন্তু এ ধারণা ভুল। সঙ্গীত মনোসংযোগ বাড়ায়।

প্রশ্ন: খারাপ লাগে না?

উত্তর: খারাপ তো লাগেই। বয়স হয়েছে। কিন্তু নিজে প্রতিদিন রেওয়াজের চেষ্টা করি। কখনও তা করতে না পারলে খারাপ লাগে। সেখানে শিষ্যরা মনে প্রাণে না শিখলে খারাপ লাগাই তো স্বাভাবিক। কারও কাছে টাকা নিয়ে বেহালা বাজানো শেখাই না। অন্তরের টান থেকেই শেখাই। তাই ওঁরা চলে গেলে মনে হয়, নিজের সময় নষ্ট না করলেই ভাল হতো।

Subodh Sen Behala
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy