Advertisement
E-Paper

মুখ্যমন্ত্রীর পরশ চান যাত্রা শিল্পীরাও

লালগড়ের হাটচালায় স্থানীয় সতীশনারায়ণ স্মৃতি সঙ্ঘ অপেরার ‘ময়ূর সিংহাসন’ পালার আসর বসেছে। দূরদূরান্ত থেকে আসা আবালবৃদ্ধবনিতার ভিড় সামলাতে হিমসিম খাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। সাজাহানের ভূমিকায় স্থানীয় যাত্রাশিল্পী সুভাষচন্দ্র চক্রবর্তীর দৃপ্ত কন্ঠের সংলাপ শুনে করতালিতে ফেটে পড়ছে জনতা।

কিংশুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৬ ০১:৩১
সোনার সে দিন... লালগড়ের যাত্রা দলের সদস্যরা। ফাইল ছবি।

সোনার সে দিন... লালগড়ের যাত্রা দলের সদস্যরা। ফাইল ছবি।

লালগড়ের হাটচালায় স্থানীয় সতীশনারায়ণ স্মৃতি সঙ্ঘ অপেরার ‘ময়ূর সিংহাসন’ পালার আসর বসেছে। দূরদূরান্ত থেকে আসা আবালবৃদ্ধবনিতার ভিড় সামলাতে হিমসিম খাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। সাজাহানের ভূমিকায় স্থানীয় যাত্রাশিল্পী সুভাষচন্দ্র চক্রবর্তীর দৃপ্ত কন্ঠের সংলাপ শুনে করতালিতে ফেটে পড়ছে জনতা। সাড়ে চার দশক আগে লালগড়ে এমন দৃশ্য হামেশাই দেখা যেত। আর্থিক সঙ্কটের জেরে জঙ্গলমহলের অধিকাংশ অপেশাদার যাত্রাদলগুলি এখন ইতিহাস।

লালগড়ের হাতে গোনা এক-দু’টি দল টিকে থাকলেও দীর্ঘদিন পালা মঞ্চস্থ বন্ধ রয়েছে। অথচ এক সময় এই লালগড়ে অপেশাদার যাত্রাদলগুলির হাত ধরে পরবর্তীকালে প্রতিভা সম্পন্ন যশস্বী নটদের দাপুটে অভিনয় দেখার সুযোগ হয়েছিল দর্শকদের। সেই সব প্রবীণ অভিনেতাদের অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন। কয়েকজন প্রবীণ শিল্পী প্রচারের অন্ধকারে দিনযাপন করছেন। তাঁদের অবশ্য কোনও সরকারি সাহায্য বা সম্মান পাওয়ার সুযোগ হয়নি। রাজ্য সরকার লোকপ্রসার প্রকল্পে জঙ্গলমহলের বহু লোকশিল্পীকে মাসিক ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। প্রতি মাসে সরকারি অনুষ্ঠান করারও সুযোগ পাচ্ছেন লোকশিল্পীরা। যাত্রাশিল্প অবশ্য লোক প্রসার প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত নয়। এ জন্য তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের অধীনে যাত্রা আকাডেমি রয়েছে। কিন্তু জঙ্গলমহলের লুপ্তপ্রায় যাত্রাদল ও যাত্রাশিল্পীদের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। জঙ্গলমহলের মুমূর্ষু যাত্রাদলগুলির পুনরুজ্জীবনে এখনও সরকারিস্তরে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন মমতা। স্বভাবতই জঙ্গলমহলবাসীর প্রত্যাশার পারদ ঊর্ধ্বমুখী। লুপ্তপ্রায় যাত্রাশিল্পের পুনরুজ্জীবনে মুখ্যমন্ত্রীর সাহায্য চান জঙ্গলমহলের প্রবীণ যাত্রাশিল্পীরা। যাত্রাশিল্পকে জঙ্গলমহলে লোকশিক্ষার অন্যতম মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করার পক্ষেও সওয়াল শুরু হয়েছে।

ষাট-সত্তরের দশকে লালগড়ের দলগুলির বেশ সুখ্যাতি ছিল। রাজ পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় দু’টি যাত্রা দলের নাম ছিল ‘সতীশনারায়ণ স্মৃতি সঙ্ঘ অপেরা’ ও ‘বিজয়নারায়ণ স্মৃতি সঙ্ঘ অপেরা’। এ ছাড়া স্থানীয় বিশিষ্টজনেরা মিলে গড়েছিলেন ‘সজীব সঙ্ঘ’। পরে গঠিত হয় লালগড় বাণীমন্দির নাট্য সংস্থা। ‘ঔরঙ্গজেব’, ‘ময়ূর সিংহাসন’, ‘কবরের কান্না’, ‘জ্বলন্ত বারুদ’, ‘শিবাজি’র মতো দারুণ সব যাত্রা মঞ্চস্থ হত। রাজার মুহুরি ভূষণ রায়, ব্লক অফিসের কর্মী সুভাষচন্দ্র চক্রবর্তী, বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী, স্থানীয় গ্রন্থাগারিক রামকৃষ্ণ তেওয়ারি, ব্যবসায়ী শশাঙ্কশেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, জেলা কালেক্টরেটের কর্মী বিমলকুমার রায়ের মতো স্থানীয়রাই অভিনয় করতেন। স্থানীয় মেক-আপ আর্টিস্ট শ্যামাপদ রায় ওরফে ধুসুবাবুর হাতযশের গুণে কুশীলবেরা ইতিহাসের জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠতেন। সেই সময় জেলা ও মহকুমাস্তরে যাত্রা প্রতিযোগিতায় স্থানীয় যাত্রাশিল্পীরা শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার ছিনিয়ে আনতেন। বাইরে শো করার জন্য ডাক পেত লালগড়ের যাত্রাদল গুলি। সেই সব গুণিজনের অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন। সুভাষবাবু, বৈদ্যনাথবাবু, শশাঙ্কবাবুর মতো প্রবীণ যাত্রাশিল্পীরা এখনও মজে রয়েছেন অতীত-স্মৃতিতে।

প্রবীণ যাত্রাভিনেতা তিরাশি বছরের সুভাষচন্দ্র চক্রবর্তীর কথায়, “তখন যাত্রার মাধ্যমে বিনোদন ও লোকশিক্ষা দু’টোই হত। ইতিহাস নির্ভর যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হত। লোকজন বিনা টিকিটের সেই সব যাত্রা দেখতে আসতেন। গ্রামীণ যাত্রাশিল্পীদের এখন আর কদর নেই। যাত্রাশিল্পীদের জন্য কেউ মাথাও ঘামাচ্ছেন না।” পরবর্তীকালে উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকের অভাবে স্থানীয় যাত্রাপালার মঞ্চায়ন ভীষণই অনিয়মিত হয়ে গিয়েছে। তবে এখনও উৎসব-পার্বণ উপলক্ষে লালগড়ে যাত্রা মঞ্চস্থ হয়। সজীব সঙ্ঘের সদস্য প্রবীণ যাত্রাশিল্পী দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এখনও অনিয়মিত ভাবে স্থানীয় যাত্রাশিল্পীদের নিয়ে পালা মঞ্চস্থ করা হয়। আর্থিক সমস্যার কারণেই গত কয়েক বছর স্থানীয় যাত্রা মঞ্চস্থ করা সম্ভব হয়নি। নতুন প্রজন্মের ছেলেরা যাত্রা নিয়ে আগ্রহী নন। একমাত্র সরকারি সাহায্যই এই শিল্পকে মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে।” আর এক যাত্রাশিল্পী তথা বাণীমন্দির নাট্য সংস্থার সদস্য রূপক সাহসরায় বলেন, “যাত্রাশিল্পীদের দিয়েও লোকশিক্ষা ও জনসচেতনতার কাজ খুব ভাল ভাবে করানো যেতে পারে। এ বিষয়ে সরকারি স্তরে পদক্ষেপ করা হলে খুব ভাল হয়।” পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক কৌশিক নন্দী বলেন, “জঙ্গলমহলের যাত্রাদল ও যাত্রাশিল্পীদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তাঁদের দাবি সমূহ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব।”

Lalgola Mamata Banerjee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy