Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

অ্যান্টনি, বলরামের সেরসায় ফুটবলই ব্রাত্য

একসময়ে অনুশীলন করতে আসত ভারতীয় ফুটবল দল। এখন সেখানে ফুটবলই দুয়োরানি। খড়্গপুরের সেরসা স্টেডিয়ামে দীর্ঘদিন বন্ধ ফুটবল প্রশিক্ষণ। লিখছেন সৌমেশ্বর মণ্ডলঅনুশীলন করে গিয়েছে ভারতীয় ফুটবল দল। 

স্মৃতির-সরণী-বেয়ে: সত্তর দশকে সেরসা স্টেডিয়ামে একটি ফুটবল প্রতিযোগিতায় উপচে পড়া িভড়। ছবি: সংগৃহীত

স্মৃতির-সরণী-বেয়ে: সত্তর দশকে সেরসা স্টেডিয়ামে একটি ফুটবল প্রতিযোগিতায় উপচে পড়া িভড়। ছবি: সংগৃহীত

শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:৩৬
Share: Save:

রেলের খড়্গপুর ডিভিশনের ফুটবলের ইতিহাস বেশ পুরনো। রেলের খেলাকে খড়্গপুরমুখী করতে পাঁচের দশকে ম্যাক ফার্নেল সাহেবের তত্ত্বাবধানে সেরসা স্টেডিয়াম গড়ে উঠেছিল। এই মাঠে খেলে গিয়েছেন এস অ্যান্টনি, শিবাজি রায়, সৌমেন মিত্র, তুলসীদাস বলরামের মতো বহু নামী ফুটবলার। অনুশীলন করে গিয়েছে ভারতীয় ফুটবল দল।

সেই সময় আন্তঃরেল লিগ হত না। রেলের দলগুলিকে নিয়ে প্রতি বছর একটি নক-আউট ফুটবল প্রতিযোগিতা হত। সেটি ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। সেই প্রতিযোগিতার কথা এখনও প্রবীণ রেলকর্মীদের মুখে মুখে ফেরে। তাঁরা জানিয়েছেন, তখন যে কোনও খেলায় মাঠ ভর্তি থাকত। মাঠে ঢোকার জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ত। সে সব এখন শুধুই অতীত। ২০০২ সাল পর্যন্ত খড়গপুর ডিভিশনের ফুটবল দলের প্রশিক্ষণ হয়েছে সেরসায়। তারপর বন্ধ। সেরসা মাঠে এক সময়ে অনেক ফুটবল প্রতিযোগিতা হয়েছে। মাঝে সেই সব দীর্ঘ দিন বন্ধ ছিল। তবে আশার কথা হল, সম্প্রতি এই মাঠে অ্যান্থনি কাপ নামে দিনরাতের ফুটবল প্রতিযোগিতা হয়েছে। তবে এই মাঠে আগে ফুটবল খেলা হলে যে উদ্দীপনা থাকত এ বার সেরকম কিছু ছিল না।

সেরসা থেকে ফুটবল হারিয়ে যেতে বসায় খড়্গপুরের প্রাক্তন ফুটবলাররা মর্মাহত। খড়গপুরের বাসিন্দা সুশীল চক্রবর্তী পঞ্চাশের দশকে রেলের ফুটবল দলে খেলেছেন। রেলের পাশাপাশি তিনি হাওড়া ইউনিয়নের হয়েও খেলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘সেরসার মাঠে তখন ফুটবলের নক্ষত্ররা আসতেন। এই মাঠেই অনুশীলন করতেন।’’ খড়গপুরের বাসিন্দা পলু দাশগুপ্ত জানান, খড়্গপুর মহকুমা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত রাধারানি শিল্ড, বেটন কাপ, স্কুল ফুটবলের আসর বসত সেরসা, বাইটন ও সুভাষপল্লির মাঠে। তখন রেল মাঠ দিয়ে মহকুমা ক্রীড়া সংস্থাকে সাহায্য করত। ডেভেলপমেন্ট স্পোর্টিং ক্লাব, ট্রাফিক রিক্রিয়েশন ক্লাব, শক্তি মন্দির ক্লাব, অন্ধ্র স্পোর্টিং ক্লাব-সহ এলাকার বিভিন্ন ক্লাব যোগ দিত। ১৯৮১ সালে জুনিয়র ন্যাশনাল বি সি রায় ট্রফি-র প্রশিক্ষণ শিবির হয়েছিল সেরসা স্টেডিয়ামে। আগে স্টেডিয়ামের একটি ঘর মহকুমা ক্রীড়া সংস্থাকে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছিল। এখন সে সব ইতিহাস।

খড়গপুর রেল ডিভিশনের প্রাক্তন ফুটবল প্রশিক্ষক অমিয় ভট্টচার্যের আক্ষেপ, ‘‘আগে সেরসায় যেভাবে ফুটবল চর্চা হত তার অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছে।’’ খড়্গপুর পুরসভার পুরপ্রধান প্রদীপ সরকার অবশ্য আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘‘সম্প্রতি ওই স্টে়ডিয়ামে অ্যান্থনি কাপ ফুটবল হয়েছে। আশা করব, সেখানে ফুটবলের প্রশিক্ষণ ফিরিয়ে আনতে সেরসার কর্মকর্তারা ব্যবস্থা নেবেন’’।

নয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব রেলের বেশিরভাগ ফুটবলার ছিল খড়্গপুর ডিভিশনের। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ফুটবল দল সেই সময়ে বেশ শক্তিশালী ছিল। শুধু রেলের প্রতিযোগিতা নয়, অন্য প্রতিযোগিতাতেও যোগ দিত তারা। আশি ও নয়ের দশকে অধুনা চক্রধরপুরে আয়োজিত স্টিল এক্সপ্রেস প্রতিযোগিতায় কয়েক বার চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স হয়েছিল দক্ষিণ-পূর্ব রেল। রাজস্থানের উদয়পুর ও জয়পুরে সারা ভারত আমন্ত্রণমূলক প্রতিযোগিতা ও কটকের কলিঙ্গ কাপেও যোগ দিয়েছিল এই দল। সব ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতার আগে অনুশীলন হত সেরসা স্টেডিয়ামে। খড়্গপুর ডিভিশন ও দক্ষিণ পূর্ব রেল দলের হয়ে বিভিন্ন সময়ে খেলেছেন প্রণব বসু, এস অ্যান্টনি, আমজাদ আলি, সুশীল চক্রবর্তী, প্রীতি ঘোষাল প্রমুখ কলকাতা ময়দানের কয়েকজন ফুটবলার। ১৯৯৯, ২০০০ ও ২০০১ সালে টানা তিন বার আন্তঃরেল ওয়ার্কশপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল খড়্গপুর ওয়ার্কশপ।

ইতিহাস সমৃদ্ধ সেরসা স্টেডিয়াম থেকে ফুটবল হারিয়ে যাচ্ছে কেন? খড়্গপুর মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শ্যামাদাস ঘোষের দাবি, এর জন্য রেল দায় অস্বীকার করতে পারে না। তিনি বলেন, ‘‘আগে এখানে নানা পর্যায়ের ফুটবল প্রতিযোগিতা হত। এখন শুধু ক্রিকেট হয়। এখন রেলের মাঠ ব্যবহার করতে গেলে অনেক টাকা দাবি করা হয়।’’ মহেন্দ্র সিংহ ধোনি খড়্গপুরে রেলের টিকিট পরীক্ষক হিসেবে চাকরি করতে আসার পর থেকেই খড়্গপুরে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। গত কয়েক বছরে সেরসা স্টেডিয়াম ক্রিকেটের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। পিছিয়ে পড়ছে ফুটবল। ধোনির নামে গ্যালারির নামকরণ হয়েছে। সম্প্রতি সিএবি-র কর্মকর্তারা সেরসা স্টেডিয়াম পরিদর্শন করে গিয়েছেন। এই মাঠে সিএবি-র জুনিয়র লিগ আয়োজনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এখন স্টেডিয়াম সংস্কারের কাজ চলছে। এর ফলে রেল শহরের ফুটবলপ্রেমীরা কিছুটা হতাশ। তাঁদের প্রশ্ন, মাঠের মাঝে পিচ থাকলে ফুটবল খেলা হবে কীভাবে? তবে একইসঙ্গে ফুটবলপ্রেমীদের পরামর্শ, সেরসা-র মাঠের পূর্ব দিকের গ্যালারি একদম সরিয়ে সীমানা পাঁচিলে নিয়ে গিয়ে বাইটন মাঠকেও এর মধ্যে নিয়ে নেওয়া উচিত। তাহলে পুরো মাঠ অনেক বড় হয়ে যাবে। ক্রিকেট পিচকে মাঝে রেখে দু’দিকে দু’টি ফুটবল মাঠ করা যাবে। ওড়িশার বরাবটি স্টেডিয়ামে এই ভাবেই ফুটবল ও ক্রিকেটের সহাবস্থান রয়েছে।

সেরসা স্টেডিয়ামে ফুটবল যে ক্রমেই দুয়োরানি হচ্ছে সে কথা মানতে নারাজ ক্রীড়া আধিকারিক রাজেশ সিংহ। তিনি জানান, কয়েক বছর আগেও এই স্টেডিয়ামে রেলের ইন্টার ডিভিশন ফুটবল হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘খড়্গপুর ডিভিশনের ফুটবলাররা বিএনআর দলে নিয়মিত অনুশীলন করেন। তাই সেরসায় স্টেডিয়ামে আলাদা করে প্রশিক্ষণ শিবির হয় না। কারণ ফুটবলাররা কলকাতায় অনুশীলন করলে খড়্গপুরে কবে অনুশীলন করবে? তবে সেরসা-র পাশে বাইটন মাঠে ৮০-৯০ জন ছেলে নিয়মিত ফুটবল অনুশীলন করছে।’’

মাঠ ব্যবহারের জন্য রেলের পক্ষ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি মেনে নিয়েছেন রাজেশবাবু। তিনি বলেন, ‘‘স্টেডিয়াম সংস্কার, পরিচর্যা ও নিরাপত্তার জন্য টাকার প্রয়োজন। সেইজন্যই কেউ মাঠ চাইলে আমরা সামান্য টাকা নিয়ে থাকি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE