সংরক্ষণের অভাবে খণ্ডহরে পরিণত নিমক মহল। সোহম গুহর তোলা ছবি।
ধ্বংসস্তূপে বিলীন হচ্ছে প্রাচীন ইতিহাস। উদাসীনতা আর অবহেলায় কাঁথির ঐতিহাসিক নিমকমহল এখন চামচিকে, বাদুড় আর বিষাক্ত সাপের আঁতুরঘর। সংরক্ষণের অভাবে কালের গর্ভে মিলিয়ে যেতে বসেছে শতাব্দী প্রাচীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লবণ ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র ‘নিমকমহল’ বা ‘বড়কুঠি’। কাঁথি মহকুমা হিসেবে গঠিত হওয়ার পর নিমকমহল বা বড়কুঠিতেই শুরু হয়েছিল কাঁথির সর্বপ্রথম মহকুমাশাসকের দফতরও। কাঁথি মহকুমাশাসকের অফিস চত্বরে আজ অতীত গৌরবময় ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হিসেবে এই স্থাপত্য।
ইতিহাস বলছে, সপ্তদশ শতকের শেষভাগে কাঁথি নামকরণ হয়নি। ১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে লবণ ব্যবসার স্বার্থে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পূর্ব কুমারপুর মৌজায় লবণ ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে এজেন্ট অফিস তৈরি করার পরেই কাঁথি রাতারাতি পাদপ্রদীপের আলোয় আসে। ১৭৮৮ সালে কোম্পানির সল্ট এজেন্ট হিসেবে এন ডবলিউ হিউয়েট নিযুক্ত হওয়ার পর কাঁথিতেই লবণ ব্যবসার স্থায়ীকেন্দ্র হিসেবে নিমকমহল তৈরি করে কাঁথি ও হিজলি পরগনায় লবণ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হন। হিজলি পরগনার মাজনামুঠার রানী সুগন্ধাদেবীর কাছ থেকে বার্ষিক এক টাকা খাজনার বিনিময়ে পূর্ব কুমারপুর, আঠিলাগড়ি ও পশ্চিম কুমারপুর তিনটি মৌজার ৩০৫ বিঘা জমি কিনে এজেন্ট অফিস তৈরি শুরু করেন। কুমারপুর মৌজার সেই এজেন্ট অফিসই গড়ে উঠেছিল সুরম্য তিনতলা বিশিষ্ট অট্টালিকা। ইতিহাসে যা আজও ‘নিমকমহল’ বা ‘বড়কুঠি’ হিসেবে পরিচিত। ।
ডর্নিথন নামে আর এক সল্ট এজেন্ট ওই জমির উপর তিনতলা প্রাসাদোপম নিমকমহল তৈরি করেন। বাড়ির গঠনে পরিষ্কার বোঝা যায় সওদাগরি অফিসের ধাঁচেই তৈরি করা হয়েছিল তিনতলা নিমকমহল। একতলায় লবণ অফিসের কাজকর্ম আর দোতলা ও তিনতলায় ছিল লবণ ব্যবসার উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বাসভবন। কাঁথিতে পুরোপুরি মহকুমা প্রতিষ্ঠার পর ইংরেজ সরকার লবণএজেন্ট ডর্নিত্থনের নিমকমহল আর সংলগ্ন জমি সেইসময় ২৫ হাজার টাকায় কিনে নিয়ে কাঁথি মহকুমা শাসকের কাছারী,বাসভবন ও উদ্যান তৈরি করে। ১৯৪২ সালে এক প্রবল ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসে তা বড়কুঠি ভীষনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই মহকুমাশাসকের অফিস চলত। ১৯৪২ সালে নিমকমহল ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পরও ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত নিমকমহলেই কাঁথির ফৌজদারি আদালত ও মহকুমা শাসকের কয়েকটি দফতরের কাজকর্ম চলত। আস্তে আস্তে সংরক্ষমের অভাবে এই স্থাপত্য জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে।
কাঁথির আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেছেন কাঁথি প্রভাতকুমার কলেজের প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রেমানন্দ প্রধান, মুগবেড়িয়া কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ হরিপদ মাইতি, মন্মথনাথ দাস, সুনীলকুমার ঘোষ, বৃহস্পতি মণ্ডল ও প্রবালকান্তি হাজরা। তাঁদের কথায়, ‘‘সরকারি সংরক্ষণের অভাবে শতাব্দী প্রাচীন এই নিমকমহল বা বড়কুঠি’র গৌরবময় ইতিহাস আজ ধ্বংশপ্রায়। অবিলম্বে সরকার ও হেরিটেজ কমিশনের পক্ষ থেকে কাঁথি ও হিজলী পরগনার লবন উৎপাদন ও ব্যবসা কেন্দ্রের ঐতিহাসিক স্মৃতি বিরজিত বড়কুঠিকে হেরিটেজ ঘোষণা ও উপযুক্ত সংরক্ষণ দরকার।”
দক্ষিণ কাঁথির বিধায়ক দিব্যেন্দু অধিকারীও নিমকমহলকে হেরিটেজ ঘোষনা করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষনের জন্য বিধায়ক হিসেবে গতবছরেই হেরিটেজ কমিশনের কাছে দরবার করেন। মঙ্গলবার দিব্যেন্দুবাবু জানান, “হেরিটেজ কমিশন নিমকমহলের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। হেরিটেজ কমিশনের এক প্রতিনিধিদল নিমকমহলের বতর্মান পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে পরিদর্শনে আসবেন বলে কমিশন থেকে বলা হয়েছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy