Advertisement
১৮ মে ২০২৪

শেষের প্রহর গুনছে ডাক বাক্স

এক সময় তার কদর ছিল ঘরে ঘরে। দুপুর বেলা পিওনের ‘চিঠি আছে গো’ ডাক শুনে দ্রুত সদর দরজায় ছুটে আসত বাড়ির কচিকাঁচারা। যার চিঠি এল না, সেও অপেক্ষা করে থাকত পরদিন দুপুরের জন্য।

এমনই হাল খড়্গপুরের অধিকাংশ ডাক বাক্সের। মন্দিরতলায়। নিজস্ব চিত্র।

এমনই হাল খড়্গপুরের অধিকাংশ ডাক বাক্সের। মন্দিরতলায়। নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
খড়্গপুর শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫ ০২:২৮
Share: Save:

এক সময় তার কদর ছিল ঘরে ঘরে। দুপুর বেলা পিওনের ‘চিঠি আছে গো’ ডাক শুনে দ্রুত সদর দরজায় ছুটে আসত বাড়ির কচিকাঁচারা। যার চিঠি এল না, সেও অপেক্ষা করে থাকত পরদিন দুপুরের জন্য। শুধু দৈনন্দিন জীবনে নয়, উৎসবের মরসুমে আপনজনকে শুভেচ্ছা জানাতেও চিঠি ছিল প্রধান মাধ্যম। স্মার্টফোনের যুগে চিঠি এখন ‘বিলুপ্তপ্রায়’। চিঠি লেখার অভ্যাস কমতে থাকায় কাজ নেই রাস্তার ধারের ডাক বাক্সগুলিরও। আগে দিনে দু’-তিন বার ডাক কর্মীরা রাস্তার ধারের বাক্স থেকে চিঠি নিতে আসতেন। এখন সেই সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে একবারে। শহরবাসীর একাংশের অভিযোগ, ডাক দফতরের উদাসীনতায় জীর্ণ অবস্থাতেই শেষের দিন গুনছে খড়্গপুর শহরের ডাক বাক্সগুলি।

ব্রিটিশ আমলেই দেশে ডাক ব্যবস্থার পথ চলা শুরু। ১৯৭২ সালে চালু হয় ‘পিনকোড’ ব্যবস্থা। শহরবাসীর একাংশের অভিযোগ, মোবাইল-ইন্টারনেটের যুগে একদিকে যেমন চিঠি লেখার অভ্যাস কমেছে, তেমনই আরও উদাসীন হয়েছে ডাক বিভাগ। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মরচে ধরছে ডাক বাক্সগুলিতে। জীর্ণ ডাক বাক্সে চিঠি ফেলার আগেও দু’বার ভাবছেন শহরবাসী অভাব। রক্ষণাবেক্ষণের বদলে তুলে নেওয়া হচ্ছে অনেক ডাক বাক্স।

এক সময় খড়্গপুর শহরে রাস্তার ধারে মোট ৩২টি চাক বাক্স ছিল। প্রতিদিন দু’বার করে ডাক বাক্স থেকে চিঠি সংগ্রহ করতেন কর্মীরা। সময়ে চিঠি পৌঁছচ্ছে কি না, তা দেখাশোনা করতেন দু’জন ‘পাবলিক রিলেশন ইন্সপেক্টর’। অভিযোগ, প্রতিদিন নয়, এখন সপ্তাহে একবার অথবা দু’বার ডাক বাক্সগুলি। এখন মহকুমাশাসকের কার্যালয়, রেলের সিস্টেম টেকনিক্যাল স্কুল-সহ ৭টি ডাক বাক্স থেকে দিনে একবার চিঠি সংগ্রহ করা হয়।

ডাক বিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, ‘লেটার বক্স পিওন’-এর পদ থাকলেও তা শূন্য। অস্থায়ী কর্মী দিয়ে ডাক বাক্স থেকে চিঠি সংগ্রহের কাজ চলছে। এমনকী দু’জন পাবলিক রিলেশন ইন্সপেক্টর’-র পদও ফাঁকা পড়ে রয়েছে। শহরের অধিকাংশ ডাক বাক্সে চিঠি না পাওয়ার অভিযোগ তুলছেন ডাক সেবকরা। সেই থেকেই আসছে অনীহা।

শহরের সুভাষপল্লি এলাকার দীর্ঘদিনের পুরনো একটি ডাক বাক্সের নীচের অংশ খুলে গিয়েছে। বাক্সে চিঠি ফেললে তা নীচের ফাঁকা অংশ দিয়ে রাস্তায় পড়ে যাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী মিন্টু চৌধুরী বলেন, “চিঠি লেখাও একটা শিল্প। এক সময়ে ঢাকা থেকে আমার আত্মীয়রা চিঠি পাঠাত। এখনও আমার সংগ্রহে সেই চিঠি রয়েছে। সমাজ তো আধুনিক হবেই। তবে আমি চাই না ঐতিহ্য হারিয়ে যাক।’’ তাঁর আক্ষেপ, ‘ডাক বাক্স এ ভাবে অবহেলায় পড়ে থাকলে নবীনরা চিঠির গুরুত্ব বুঝবে কী ভাবে? এ বিষয়ে ডাক বিভাগের ভাবার সময় এসেছে!”

বছর কয়েক আগেও খড়্গপুর উপ-ডাকঘরের অধীনে ৩৬ জন পোস্টম্যান ছিলেন। এখন সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ২৫ জনে। এ ক্ষেত্রে পোস্টঅফিস থেকে চিঠি নিয়ে বের হলেও পোস্টম্যানরা কিছু চিঠি পথেই পুড়িয়ে দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠছে। শহরের বাসিন্দা আইনের ছাত্র রাজেশ ভট্টাচার্য কথায়, “ছোটবেলায় আত্মীয়স্বজনকে অনেক চিঠি লিখেছি। অনেক সময় মজা করে শহরেই বন্ধুবান্ধবকে পোস্টকার্ডে চিঠি পাঠিয়েছি। তখন একদিনে চিঠি পৌঁছে যেত। কিন্তু এখন চাকরীর পরীক্ষার অ্যাডমিট আসে পরীক্ষার পরে।” এ বিষয়ে একসময় ‘পাবলিক রিলেশন ইন্সপেক্টর’-এর পদে কাজ করা অবসরপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার বীরেন মাইতি বলেন, “আমার মনে হয় চিঠির গুরুত্ব আজও আছে।’’ তিনি বলেন, ‘‘পাবলিক রিলেশন ইন্সপেক্টর পদে থাকার সময়ে বিভিন্ন ডাক বাক্সে নকল চিঠি ফেলতাম। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, সে গুলি নিদিষ্ট গন্তব্যে সঠিক সময়ে পৌঁছচ্ছে কি না সেটা দেখা। কিন্তু কর্মীর অভাবে এখন এ সব আর হয় না।”

যদিও খড়্গপুর উপ-ডাকঘরের পোস্টমাস্টার অভিজিত সাঁই বলেন, “আগের তুলনায় কর্মীর অভাব রয়েছে। তা সত্ত্বেও ডাক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘চিঠি লেখায় অনীহা দেখা যাচ্ছে। এখন দিনে গড়ে মাত্র ৪২টি ব্যক্তিগত চিঠি পাই।’’ ডাক বাক্সগুলির রক্ষণাবেক্ষণ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘নতুন ডাক বাক্সের সরবরাহ বন্ধ। তাই শহরের জীর্ণ ডাক বাক্সগুলি তুলে নেওয়া হচ্ছে। তবে সাধারণ মানুষ যদি ডাক বাক্স বদলের প্রস্তাব দেয়, তবে নিশ্চয় বদলের চেষ্টা করব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

postal box post office
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE