সৈকতে কি নিয়ম নাস্তি!
মন্দারমণি ও তাজপুরে ‘সিআরজ়েড’ (কোস্টাল রেগুলেটেড জ়োন) আইন ভেঙে মাথা তুলছে রিসর্ট, লজ— অভিযোগ এমনই। আবার সেখানে জমির আইনি অধিকার দেওয়াও সরকারি ভাবে শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, অবৈধ হোটেল-লজকে ‘বৈধ’ করে তুলতেই কি তৎপরতা!
নিয়ম বলছে, জোয়ারে সমুদ্রের জল যত দূর পৌঁছয়, সেখান থেকে ৫০ মিটারের মধ্যে কোনও নির্মাণ করা যায় না। অথচ, মন্দারমণির দাদনপাত্রবাড়ে গিয়ে দেখা গেল, এমন লজও রয়েছে, জোয়ারের সময় যার দেওয়ালে আছড়ায় সমুদ্রের ঢেউ। সৈকতের ধারে প্রায় সব হোটেলে জোয়ারের জল ‘গার্ডওয়াল’ টপকে ঢোকে। সিলামপুর, দক্ষিণ পুরুষোত্তমপুর, সোনামুই মৌজায় নিচু জলাজমি ভরাট করে চলছে নির্মাণ। তাজপুরে সৈকতে কংক্রিটের খুঁটি পোতা হয়েছে। যেখানে নিয়মিত ঢেউ এসে পড়ছে, সেখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ‘গার্ডওয়াল’ হচ্ছে। বিস্তীর্ণ এলাকায় কেয়া গাছ আর ঝাউ-জঙ্গল কাটা হয়েছে। সমুদ্রের ঢেউ যত দূর আসে, সেখান থেকে ৫০ মিটারের আগেই রয়েছে বড় লজ।
মন্দারমণির ১৪৪টি বেআইনি নির্মাণ ভাঙার নির্দেশ দিয়েছিল জাতীয় পরিবেশ আদালত। তা নিয়ে হাই কোর্টে পাল্টা মামলা হয়েছে। সে সব বাদেও, সম্প্রতি মন্দারমণির ১২টি বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করেছে পুলিশ। স্থানীয় সূত্রের খবর, পুলিশি অভিযানে কয়েকটি নির্মাণ বন্ধ হলেও, ফের কাজ শুরু হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পুলিশের ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট (ডিসিপ্লিন অ্যান্ড ট্রেনিং) আবু নুর হোসেন বলেন, “সব দেখা হচ্ছে।”
অভিযোগ, তাজপুরে সরকারি জমিতে হয়েছে রিসর্ট, লজ। দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের সবুজরক্ষী বাহিনী নির্মাণ বন্ধে গিয়ে বাধা পাচ্ছে। পর্ষদের এগজ়িকিউটিভ অফিসার অপূর্বকুমার বিশ্বাস বলেন, “পদক্ষেপ হবে।” তাজপুর হোটেল মালিক সংগঠনের সভাপতি শ্যামলকুমার দাসের বক্তব্য, “আমরা সতর্ক করি। তার পরেও কেউ বিধি ভাঙলে, প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
এরই মধ্যে প্রায় দেড় দশক বাদে মন্দারমণি এবং তাজপুরে জমির ‘মিউটেশন’ (মালিকানা সংশোধন) এবং ‘কনভারশন’ (চরিত্র পরিবর্তন) শুরুর অনুমতি দিয়েছে জেলা প্রশাসন। প্রায় পাঁচশো আবেদন জমা পড়েছে বলে রামনগর-১ ও ২ ব্লক প্রশাসন সূত্রের খবর। অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি) বৈভব চৌধুরী বলেন, “মিউটেশনে শুধু জমির হাতবদল হচ্ছে। তবে কনভারশনের ক্ষেত্রে সিআরজ়েড দেখে শংসাপত্রদেওয়া হচ্ছে।”
মন্দারমণির হোটেল মালিকদের বক্তব্য, যে সব হোটেল ভাঙার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলি তৈরির সময় ‘সিআরজ়েড’-সীমা চিহ্নিত করা হয়নি। মন্দারমণি হোটেল মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মমরেজ আলির দাবি, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সংগঠনগত ভাবে প্রস্তাব রেখেছিলাম। যত দূর জানি, তার ভিত্তিতে ‘মিউটেশন’, ‘কনভারশন’ হচ্ছে।”
বাম জমানায় পরিবেশের স্বার্থে সৈকত এলাকায় জমির ‘মিউটেশন’ এবং ‘কনভারশন’ বন্ধ হয়েছিল। পরিবেশকর্মী ও বিশেষজ্ঞদের দাবি, সৈকত লাগোয়া জমির মালিকানা মেলার অর্থ বেআইনি নির্মাণের ‘ছাড়পত্র’। তাতে পরিবেশের বিপদ বাড়বে। রাজ্য সরকারের জীববৈচিত্র সম্মানপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রীতিরঞ্জন মাইতির মতে, “সৈকতে কংক্রিটের জঙ্গলের পরিণতি কী হতে পারে, ঘূর্ণিঝড় ‘আমপান’, ‘ইয়াস’ তা দেখিয়েছে। এমন চললে সমুদ্র আরও আগ্রাসী হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও বাড়বে।” দিঘা উপকূলে দীর্ঘদিন ধরে জীববৈচিত্র রক্ষায় কাজ করা ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ডরিসার্চ’, কলকাতার অধ্যাপক পুণ্যশ্লোক ভাদুড়ির মতে, “সিআরজ়েড-বিধির সঙ্গে আপস করা হচ্ছে। এতেসামুদ্রিক মাছ কমছে। কর্দমাক্ত হচ্ছে সৈকত। আখেরে পর্যটনেরওক্ষতি হবে।”
ঘটনায় রাজনৈতিক চাপান-উতোরও চলছে। দক্ষিণ কাঁথির বিজেপি বিধায়ক অরূপকুমার দাসের দাবি, “পরিবেশ আদালতের নির্দেশ কার্যকর হয়নি। উল্টে, মুখ্যমন্ত্রী এখন অবৈধ হোটেল বৈধ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।” স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী অখিল গিরির পাল্টা দাবি, “আইন মেনে সব হচ্ছে।” তবে সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আশিস প্রামাণিকের টিপ্পনী, “তৃণমূল ও বিজেপি নেতাদের বিনিয়োগ রয়েছে সৈকতে। তাই ওঁরা চুপ।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)