Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Mothers

সহ্যশক্তি দাও, চাইছেন সন্তানহারা মা

ঝাড়গ্রাম ব্লকের আগুইবনি অঞ্চলের শিমলি গ্রাম জঙ্গলঘেরা। জঙ্গলমহলের মানুষের স্বাভাবিক একটা জীবন সংগ্রাম থাকে। সবিতার যেন বেশি করে ছিল।

অঙ্কন: কুণাল বর্মন।

অঙ্কন: কুণাল বর্মন।

কিংশুক গুপ্ত
ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:০৩
Share: Save:

কাশফুল দেখলে কারও এত কান্না পায়! সবিতা মাহাতোর পায়। জমির ধারে কাশফুল ফুটতে শুরু করলে একদলা কান্না বুক ঠেলে উঠতে চায়। ভেজা দৃষ্টিতে যেন দেখতে পান ছোট ছোট দু’টো ছেলেকে। কাশফুল তুলে এনে উঠোনে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছে ছেলে দু’টো। দুই ভাই। সে ক্ষণিকের আনন্দ-ছবি। তার পর তো সব হারিয়ে একা হয়ে যাওয়া।

ঝাড়গ্রাম ব্লকের আগুইবনি অঞ্চলের শিমলি গ্রাম জঙ্গলঘেরা। জঙ্গলমহলের মানুষের স্বাভাবিক একটা জীবন সংগ্রাম থাকে। সবিতার যেন বেশি করে ছিল। অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। দুই মেয়ে আর দুই ছেলেকে মানুষ করার লড়াইটা বেশ কঠিন ছিল। লড়াই করতে করতেই এক সময় ভরে উঠেছিল সবিতার সংসার। ছেলে-বৌমা, নাতি, নাতনি। কিন্তু জঙ্গলমহলে একসময়ে সত্যি নেমে এল যুদ্ধের পরিবেশ। ইতিউতি মাইন ফাটার আওয়াজ আর পথেঘাটে রক্তাক্ত দেহ। সেই আতঙ্কের বলি হয়ে গেলেন সবিতার দুই ছেলে। ২০১০-১১ সালে মাওবাদী সন্ত্রাস পর্বে।

জীর্ণ টালির ছাদের মাটির বাড়িতে একাই থাকেন সত্তরোর্ধ্ব সবিতা মাহাতো। মাটির বাড়ির দাওয়ায় বসে সাদা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলেন, ‘‘বড় ছেলেটাকে ভাতটুকুও খেতে দেয়নি ওরা। নিয়ে চলে গেল। পরদিন লাশ মিলল রাস্তার ধারে। পরের বছর ছোট ছেলেও নিখোঁজ হয়ে গেল!’’ শরৎ সকালের রোদ এসে পড়েছে বাড়ির উঠোনে। হিমেল বাতাসে শিরশিরে আমেজ। উঠোনে মুরগি চরে বেড়াচ্ছে। বৃদ্ধা বলে চলেছেন সন্তান হারানোর কথা। বড় ছেলে অসিতের মনোহারি দোকান ছিল কলকাতা-মুম্বই জাতীয় সড়কের ডিবি চকে। ছোট ছেলে গৌতম দিনমজুরি করতেন। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের জিগির তুলে তখন এলাকা শাসন করত মাওবাদীরা। আতঙ্কে নাতি-নাতনি আর দুই বৌমাকে তাঁদের বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন সবিতা। কিন্তু তাতেও আঘাত আটকানো গেল কোথায়?

জনসাধারণের কমিটির নেতা উমাকান্ত মাহাতো পুলিশের খাতায় ছিলেন মাওবাদী। ২০১০ সালের অগস্টের এক রাতে উমাকান্তকে এলাকার জঙ্গলপথে গুলি করে মারল যৌথবাহিনী। ঘটনার একদি‌ন পরই সবিতার বাড়িতে হাজির জনসাধারণের কমিটির লোকজন। দুপুরে দোকান থেকে ফিরে সবে ভাত খেতে বসেছিলেন অসিত। মিটিংয়ের নাম করে ডেকে নিয়ে গেল তারা। পরদিন মাতালশোলের পুকুর পাড় লাগোয়া রাস্তার ধারে মিলল অসিতের গুলিবিদ্ধ দেহ। পাশে ছিল লাল কালিতে ‘পুলিশের চর’ লেখা কাগজ। এলাকায় কান পাতলে শোনা যায়, মাওবাদীদের সন্দেহ ছিল, উমাকান্তের গতিবিধির খবর এলাকারই কেউ পুলিশকে দিয়ে থাকবে। সেই সন্দেহে এলাকার আরও কয়েকজনকে ‘চরম শাস্তি’ দিয়েছিল মাওবাদীরা। সবিতা বলেন, ‘‘শুধু সন্দেহ করেই আমার ৩৫ বছরের তরতাজা ছেলেটাকে মেরে দেওয়া হল।’’ সন্তান শোকের চোখের জল আর শুকোল না বৃদ্ধার চোখে। আঘাত এল আবার।

অসিত খুন হওয়ার বছর খানেকের মধ্যে তাঁর ভাই বছর আঠাশের গৌতমও হারিয়ে গেলেন। সবিতা বলে চলেন, ‘‘এলাকার পরিস্থিতি তখন ভাল ছিল না। মহারাষ্ট্রে কাজের খোঁজ পেয়েছিল ছেলেটা। বাড়ি থেকে বেরোল। আর ফিরে এল না গৌতম।’’ গ্রামের চৌহদ্দি থেকেই হারিয়ে যান গৌতম, জঙ্গল ঘেরা গ্রামে এখনও শোনা যায় সেই কথা। মায়ের আশঙ্কা, বড় ছেলের মতো পরিণতি হয়েছে ছোট ছেলেরও। রাজ্য সরকার গৌতমকেও মৃত ঘোষণা করে তাঁর স্ত্রী মঞ্জুকে স্পেশাল হোমগার্ডের চাকরি দিয়েছে। বাবার মৃত্যুর ক্ষতিপূরণজনিত স্পেশাল হোমগার্ডের চাকরি পেয়েছেন অসিতের মেয়ে মমতা। সবিতা জানান, ক্ষতিপূরণের টাকা দুই বৌমা পেয়েছেন। সবিতার কথায়, ‘‘ওদের পুরো জীবনটা পড়ে রয়েছে। ক্ষতিপূরণ ওদেরই পাওয়া উচিত ছিল বলেই পেয়েছে।’’

কী করে চলে তাহলে? প্রতি মাসে এক হাজার টাকা বিধবা ভাতা পান। পান রেশনের চাল। বিঘে দেড়েক জমি ভাগ চাষে দেওয়া আছে। তাতে চাষ হলে বছরে একবার পাঁচ হাজার টাকা মেলে। আর ছোট বৌমা মাঝেমধ্যে সাহায্য করেন। এসে খোঁজ নিয়ে যান। পুজোয় দুই বৌমা নতুন কাপড় দেন। সেই কাপড় পরে হেঁটে বিরিহাঁড়ি গ্রামের দুর্গাপুজোর মণ্ডপে গিয়ে প্রণাম করেন। দুই মেয়েও খোঁজ নেন। তাঁর লক্ষ্মী, সরস্বতী। সবিতার কার্তিক, গণেশ তো হারিয়ে গিয়েছে। সরকারি প্রকল্পে বাড়ি পাননি। তবে শুনেছেন তাঁর নাকি নাম উঠেছে প্রাপক তালিকায়। গ্রামের কৃত্তিবাস মাহাতো, অচিন্ত্য শীটের মতো অনেকেই সবিতার খোঁজখবর রাখেন। নিয়মিত সাহায্য করেন। ভাতায়, সাহায্যে কি বছরভর জীবন চলে! তাই কাজ করতে হয় বৃদ্ধাকে। জঙ্গল থেকে শালপাতা সংগ্রহ করে বিক্রি করেন। চৈত্র মাসে মহুলের ফুল কুড়োতে যান জঙ্গলে। ভয় সেখানেও। জঙ্গলে হাতি আছে। তাতে পরোয়া করলে কি পেট চলে? সবিতা বলেন, ‘‘হাতিঠাকুর মারলে মারবে। ঠাকুর তো আমার দু’টো ছেলেকেই কেড়ে নিল।’’

জঙ্গলে শালের মঞ্জরী হয়। আবার পাতা ঝরে। কাশফুল ফোটে জমির ধারে। কাশফুল নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা দুই ছেলের কথা মনে করতে করতে মাটির ঘরে একাকী বৃদ্ধার জীবন চলে। সবিতা বলে চলেন, ‘‘পুজো এলেই বলি, মাগো সব সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা যখন দিয়েছ তখন কষ্ট সইবার শক্তিও দাও!’’

ডুকরে কেঁদে ওঠেন বৃদ্ধা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Struggle
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE