Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

প্রাণ বাঁচাতে ওঝাদের প্রশিক্ষণ

হাসপাতালে না গিয়ে সর্পদষ্ট মেয়েকে প্রথমে ওঝার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবা-মা। ওঝার ঝাড়ফুঁকে সুস্থ হওয়া দূরের কথা, অবস্থা আরও খারাপ হয় ওই কিশোরীর। অবস্থার অবনতি হচ্ছে দেখে শেষমেশ তারাবাতি মাণ্ডিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বরুণ দে
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৬ ০০:১০
Share: Save:

হাসপাতালে না গিয়ে সর্পদষ্ট মেয়েকে প্রথমে ওঝার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবা-মা। ওঝার ঝাড়ফুঁকে সুস্থ হওয়া দূরের কথা, অবস্থা আরও খারাপ হয় ওই কিশোরীর। অবস্থার অবনতি হচ্ছে দেখে শেষমেশ তারাবাতি মাণ্ডিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে হাসপাতালে আনার পথে মৃত্যু হয় গোয়ালতোড়ের ধামচা হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী ওই কিশোরীর। গত সেপ্টেম্বর মাসের এই ঘটনার পরেই তারাবাতির স্কুলে এক সচেতনতা শিবির হয়। ওই স্কুলের সহ-শিক্ষক বিপ্লব মাহাতো বলছিলেন, “এ রকম কুসংস্কারের বলি যে কেউ হতে পারে। সাপের কামড় সম্পর্কে সবস্তরে সচেতনতা আরও বাড়াতে হবে। না হলে সর্পদষ্টের প্রাণ এ ভাবে বেঘোরেই চলে যেতে পারে।”

শুধু তারাবাতি নয়, হাসপাতালে দেরিতে নিয়ে যাওয়ায় এমন সর্পদষ্টের প্রাণ যাওয়ার উদাহরণ রয়েছে ভুরি ভুরি। সর্পদষ্টকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে মাঝে-মধ্যে শিবিরও হয়। যদিও তাতেও বিশেষ কাজ হয়নি। তাই এ বার পশ্চিম মেদিনীপুরে ওঝাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যে সব এলাকায় বেশি সংখ্যক মানুষ সাপের ছোবল খায়, সেই সব এলাকায় এই প্রশিক্ষণ শিবির হবে। ওঝাদের বোঝানো হবে, পুরনো ধ্যানধারণা আঁকড়ে থাকলে হিতে বিপরীতই হবে। ঝাড়ফুঁক করে সর্পদষ্টকে বাঁচানো যায় না।

জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরার আশ্বাস, “সাপের কামড় সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির সব রকম চেষ্টা চলছে।” গিরীশচন্দ্রবাবু বলেন, “এ বার ওঝাদের নিয়ে প্রশিক্ষণ শিবির হবে। ওঁদের যদি সাপের কামড় সম্পর্কে বোঝানো যায়, আশা করি পরিস্থিতির অনেকখানি উন্নতি হবে। সাপের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনা যাবে।”

•যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান

•সে ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা গ্রামীণ হাসপাতালে যান

•ক্ষতস্থানে বরফ লাগাবেন না, গরম সেঁক দেবেন না

•কোনও রাসায়নিক লাগানো বা বিষ বের করার চেষ্টা করবেন না

•হাত-পা নড়াচড়া বন্ধ, খুলে ফেলতে হবে হাতঘড়ি বা চুড়ি

•চন্দ্রবোড়ার কামড়ে প্রতি মিনিট গুরুত্বপূর্ণ

কেশপুর দিয়েই এই শিবির শুরু হতে পারে। পরে অন্য ব্লকগুলোতেও শিবির হবে। সাপের কামড়ে মৃত্যু হলে নিয়ম অনুযায়ী পরিবারপিছু এক লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হয় রাজ্য সরকারকে। এই ক্ষতিপূরণ দিয়েই দায় সারে রাজ্য। সাপের ছোবল নিয়ে সে ভাবে সচেতনতামূলক প্রচারও চোখে পড়ে না বলে অভিযোগ। সর্পদষ্টের মৃত্যু কমিয়ে আনতে রাজ্যের হেলদোল নেই বলেও অভিযোগ। জেলাও প্রায় হাত গুটিয়ে বসে! এর ফলে পশ্চিম মেদিনীপুরে সর্পদষ্টের সংখ্যা সেই ভাবে কমছে না। ২০১৪ সালে ৬২১ জনকে সাপে কামড়ায়। মৃত্যু হয় এক জনের। ২০১৫ সালে ৬৯৮ জনকে সাপে কামড়ায়। মৃত্যু হয় ৪ জনের। ২০১৬ সালে এখনও পর্যন্ত সাপের ছোবলে জেলার দু’জন প্রাণ হারিয়েছে।

জেলার উপ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক রবীন্দ্রনাথ প্রধান বলেন, “কিছু মানুষের অজ্ঞতা, কুসংস্কার এখনও ঘোচেনি। তাই সাপে কামড়ালে এখনও কেউ কেউ ওঝা, গুণিনের দ্বারস্থ হচ্ছেন। সর্পদষ্ট রোগীকে হাসপাতালমুখী করতে এবং ওঝাদের সচেতন করতে তাই এ বার প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”

শিবিরে ঠিক কী কী জানানো হবে? জানানো হবে, সাপের বিষের এখন একমাত্র আধুনিক চিকিৎসা হল ‘অ্যান্টিভেনম’ (এভিএস) বা বিষ প্রতিষেধক। এটা তৈরি করা হয় সাপের বিষ থেকে। বিষ একপ্রকার প্রোটিন যা রক্তে অ্যান্টিজেন হিসেবে কাজ করে। সর্পদষ্টকে আগে প্রাথমিক হাসপাতাল বা গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। হাসপাতালে চিকিৎসক থাকলেই সাপে কাটার চিকিৎসা সম্ভব। সাপে কামড়ানোর পর আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সাপটিকে নিয়ে যাওয়ার বা ধরতে চেষ্টা করারও দরকার নেই। আক্রান্ত জায়গায় শক্ত বাঁধন দেওয়ার দরকার নেই। বিষ টানার চেষ্টা করার দরকার নেই। ক্ষতকে ব্লেড বা ছুরি দিয়ে কাটা যাবে না। ক্ষতে বরফ বা জলদেওয়া যাবে না।

অ্যান্টিভেনম সেরাম কী?

সাপের বিষ থেকে তৈরি এই প্রতিষেধক আসলে একপ্রকার প্রোটিন যা রক্তে অ্যান্টিজেন হিসেবে কাজ করে। সাপের বিষে একমাত্র আধুনিক চিকিৎসা।

জেলার এক স্বাস্থ্য- কর্তার কথায়, “চন্দ্রবোড়ার কামড়ে প্রতি মিনিট গুরুত্বপূর্ণ। শহরের বড় হাসপাতালে যাওয়ার জন্য যে ১৫- ২০ মিনিট অতিরিক্ত খরচ হবে, সেটা মারাত্মক হতে পারে। এক মিনিট নষ্ট হলে কিডনি খারাপ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এক শতাংশ বেড়ে যায়।” সেই কারণেই সর্পদষ্টকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ওঝাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সাপের কামড়ে মৃত্যু কমিয়ে আনা যায় কি না, সেটাই দেখার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

snake bites training
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE