Advertisement
E-Paper

ষাটের বাতাস লাগে না আর তালপাতার পাখায়

পাখাগ্রাম।আশপাশের বিশটা গ্রামের মানুষ এ নামেই চেনে বাঘাদাঁড়িকে। এক সময় কাঁথি-৩ ব্লকের ওই গ্রামের ঘরে ঘরে তৈরি হত তালপাতার পাখা। এখন অবশ্য সাকুল্যে একটি পরিবার বয়ে নিয়ে চলছে ঐতিহ্যের ব্যবসা।

সুব্রত গুহ

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৬ ০১:৩০
চলছে তালপাতার পাখা তৈরি। সোহম গুহর তোলা ছবি।

চলছে তালপাতার পাখা তৈরি। সোহম গুহর তোলা ছবি।

পাখাগ্রাম।

আশপাশের বিশটা গ্রামের মানুষ এ নামেই চেনে বাঘাদাঁড়িকে। এক সময় কাঁথি-৩ ব্লকের ওই গ্রামের ঘরে ঘরে তৈরি হত তালপাতার পাখা। এখন অবশ্য সাকুল্যে একটি পরিবার বয়ে নিয়ে চলছে ঐতিহ্যের ব্যবসা।

কারণ? হাল ফ্যাশন কমিয়ে দিয়েছে সাবেক কালের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসটির গুরুত্ব। একে তো মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। শহরের ঘরে ঘরে বৈদ্যুতিন পাখা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। লোডশেডিং-ও কমে গিয়েছে অনেকটা। বেশিরভাগে গ্রামেই এসেছে বিদ্যুৎ সংযোগ। ফলে হাতপাখার চাহিদা এমনই গিয়েছে কমে। তার উপর যোগ হয়েছে ফাইবারের পাখার সস্তা-বাজার। আগে বাজার ছেয়ে থাকত ফ্যাশনের জাপানি হাতপাখায়। তবে তার সঙ্গে তালপাতার পাখার কোনও বিরোধ ছিল না। কিন্তু এখন ফাইবারের পাখা তৈরি হচ্ছে তালপাতা পাখার আদলে। বিক্রি হচ্ছে অনেক কম দামে। ফলে কয়েক বছর আগেও যে বাঘাদাঁড়ি গ্রামের প্রায় ৭০-৮০ ঘর মানুষ তালপাতার পাখা তৈরির কাজে যুক্ত থাকতেন। সেখানেই এখন মাত্র একটি পরিবার টিঁকে আছে।

হারিয়ে যেতে বসা গ্রামীণ ঐতিহ্যের পাখা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে লড়াই করছেন গোবর্ধন ভুঁইয়া ও তাঁর পরিবার। গত তিন দশক ধরে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত তাঁরা। সকলে ছেড়ে দিলেও হাল ছাড়েননি গোবর্ধনবাবু।

নিজের বাড়ির উঠেনে বসে তালপাতা কেটে কেটে রাখছিলেন গোবর্ধনবাবু। কথা বলতে গিয়ে শুকনো গলাতেও আক্ষেপ ঝরে পড়ে, ‘‘বছর পাঁচেক আগেও গ্রামের সকলে তালপাতার পাখা তৈরি করতেন। এখন ফাইবারের পাখার চাহিদা বেশি। রুজির আশায় সবাই এখন সে দিকেই ঝুঁকছেন।’’

চাহিদা নেই। বাজারও খারাপ। শুধু গরমের চার-পাঁচ মাস পাখার চাহিদা থাকে। খান কয়েক অল্প দামের পাখা বিক্রি হয়। আর আছে কিছু মেলা। শিল্পরুচির সে সব মেলায় দু’একখানা দামী পাকা কিনে নিয়ে যান শহুরে বাবুরা। ঘর সাজানোর উপকরণ হিসাবে। কিন্তু তাতে কি আর পেট ভরে? তাই সব্জির ব্যবসা করতে হয় সারা বছর।

গোবর্ধনবাবুর কথায়, “একসময় তালপাতার হাতপাখার এতো চাহিদা ছিল যে পাইকারদের যোগান দিতে হিমসিম খেতে হত। সে সব দিন আর নেই।” গ্রামের দুই হাতপাখা শিল্পী তপন মণ্ডল ও সুধাংশু ভুঁইয়া একসময় তালপাতার পাখা তৈরি করতেন। এখন তাঁদের যাবতীয় কাজ ফাইবারে। জানালেন, তালপাতার তুলনায় ফাইবারের হাতপাখা তৈরি করতে সময় ও পরিশ্রম দুটোই কম লাগে। ফাইবারের রোল কিনে এনে পাখার সাইজে তা কেটে নিতে হয়। তারপর বাঁশ বা প্লাস্টিকের সরু কাঠি তার দিয়ে মুড়ে দিলেই পাখা তৈরি। শুধু যে খরচ কম তাই নয়, বাজারে চাহিদা বেশি।

ব্যতিক্রমী গোবর্ধনবাবু শুধু ‘ভাল লাগে’ বলেই টিঁকিয়ে রেখেছেন পুরনো কাজ। তবে কত দিন পারবেন, জানেন না নিজেও। পাখা তৈরিতে সাহায্য করেন তাঁর স্ত্রীও। সকাল থেকে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাঁচা তালপাতা জোগাড় করে আনতে হয়। তারপর সেগুলি রোদে শুকোনো। উঠোন জুড়ে রোদে মেলে রাখা তালপাতা একটু একটু করে শুকোয়। বুনো গন্ধে বুঁদ হয়ে থাকে গোটা বাড়ি। তবে না পাখা তৈরি। পাখার সৌন্দর্য বাড়াতে তালপাতা দিয়েই তৈরি হয় নকশা। যা জু়ড়ে দেওয়া হয় পাতার পাখার উপর। গরমের সময় গোবর্ধনবাবু সেই পাখা নিয়ে বিভিন্ন মেলা ও হাটে হাটে বিক্রি করে থাকেন। বছরের বাকি সময় সব্জির ব্যবসা করেন। কিন্তু হাত চলে প্রাণের টানে। তালপাতার সরু ঝুরি দিয়ে তুরন্ত নকশা তুলতে তুলতে গোবর্ধনবাবু বলেন, “বিড়ি শ্রমিকদেরও সরকারি স্বীকৃতি আছে। আছে নানা সুযোগ সুবিধা। আমাদের কিছু নেই। ব্যাঙ্ক থেকেও ঋণ
মেলে না।’’

সত্যি যদি এমন কিছু সুবিধা দেওয়া হত, তা হলে অন্তত কিছুটা সুরাহা হত এই শিল্পী পরিবারগুলির। হয়ত সংসার চালানোর একটা পথ পেলে এই শিল্পের হাত ছাড়তেন না তপন মণ্ডল, সুধাংশু ভুঁইয়ারাও। কিন্তু কী হবে ভবিষ্যৎ? কপাল ফিরবে, নাকি হাটে হাটে ঘুরে তালপাতার পাখা বেচা শেষ মানুষটিও ছাড়বেন এই পথ!

শূন্য চোখে গোবর্ধনবাবু বলেন, ‘‘জানি না।’’

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy