ব্রাহ্মণবাড় গ্রামের বিস্ফোরণস্থলে ধ্বংসস্তূপ। ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে গাড়িও (উপরে বাঁ দিকে)। এক বছর পরে আগাছায় ঢেকেছে ঘটনাস্থল। চিহ্ন বলতে কয়েকটা তুবড়ির খোল (ডান দিকে)। — রামপ্রসাদ সাউ।
এ এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।
রক্তের দাগ শুকিয়ে গেলেও ক্ষতটা আজও দগদগে।
ঘটনার রাতের স্মৃতি মনে পড়লে আজও শিউড়ে ওঠে পিংলার বিস্ফোরণের গ্রাম।
দিনটা ছিল ২০১৫ সালের ৬ মে, বুধবার। রাত তখন সাড়ে ন’টা হবে। খাওয়াদাওয়া সেরে তখন ঘুমের পথে ব্রাহ্মণবাড়। রাতের নৈশব্দ খানখান করে হঠাৎ প্রচণ্ড কানফাটা আওয়াজ। এত রাতে হলটা কী? জানতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল গোটা গ্রাম। মিনিট কয়েক পরে সম্বিৎ ফিরতেই নজরে এল, গ্রামেই ঘটে গিয়েছে বিস্ফোরণ। কয়েক কিলোমিটার দূরেও শোনা গিয়েছিল বিস্ফোরণের শব্দ। তারপর কী ঘটেছিল সকলেরই জানা। বিস্ফোরণ কেড়ে নিয়েছিল ৯ নাবালক-সহ ১৩ জনের প্রাণ।
এখন অবশ্য আগাছায় ঢেকেছে বিস্ফোরণস্থল। কয়েকটা তুবড়ির খোল, স্টোনচিপস্ই যা এখনও দগদগে ক্ষত হিসেবে রয়ে গিয়েছে। বাকি এলাকা সাফসুতরো। জমিতে দিব্যি গজিয়ে উঠেছে লাউ, বেগুন গাছ। কে বা কারা ওই জমিতেই কাঁচা আমও শুকোতে দিয়েছে।
বিস্ফোরণকাণ্ডে ঘটনাস্থল লাগোয়া মাইতি বাড়ির দুই ছেলে রঞ্জন ও নিমাই এখন জেলে রয়েছে। অভিযোগ, বাড়ি লাগোয়া জমিতে রঞ্জনের মদতেই বাজি কারখানার নামে বোমা তৈরি হত। রঞ্জন এলাকায় তৃণমূল কর্মী হিসেবেই পরিচিত। বিস্ফোরণের পরদিনই রঞ্জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে রঞ্জনের আরও এক ভাই নিমাইকেও ধরা হয়। দীর্ঘদিন পালিয়ে বেড়ানোর পর মাইতি পরিবারের বাকিরাও বাড়ি ফিরেছে।
মাইতি বাড়ির বধূ বৃষ্টিদেবীকে দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করেই ফেললাম সামনের জমিতে কে সব্জি চাষ করেছে? খানিকটা ইতস্তত করে রঞ্জনের ভাই বাবলুর স্ত্রী বৃষ্টিদেবী উত্তর দিলেন, ‘‘ওই সময়ে হয়তো সব্জির বীজ ছড়িয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকেই সব্জি গাছ হয়েছে। তবে জমি ফাঁকা দেখে আমরাই আম শুকোতে দিয়েছি।’’ ওই জমি কি আপনাদের? তাঁর উত্তর, ‘‘কী জানি বলতে পারব না।’’ গ্রামবাসীরা যে অভিযোগ করছে, ওই জমিটা আপনাদেরই। আর কোনও কথা বলতে চাননি তিনি। যদিও তাঁর দাবি, ‘‘আমরা তো কিছুই জানি না। গ্রামের লোকেরা আমাদের বাড়ির ছেলেদের ফাঁসিয়েছে। ওঁরা এখনও আমাদের হুমকি দেয়।”
নলকূপ থেকে জল নিচ্ছিলেন মিনতি টুডু। বিস্ফোরণের কথা মনে পড়ে? মিনতিদেবীর উত্তর, ‘‘মনে তো পড়ে নিশ্চয়। কিন্তু যত ভুলে থাকা যায় ততই ভাল। কারণ ওই কথা মনে করলেই রঞ্জন মাইতির গ্রামে দাপিয়ে বেড়ানোর কথাও মনে পড়ে যায়। আমরা এখন শান্তিতে আছি।” মাইতি বাড়ির অদূরেই বাড়ি পার্বতী হেমব্রমের। তিনিও বলছেন, ‘‘এখন ভয় রঞ্জন মাইতিকে নিয়ে। ওই লোকটা ফিরলে কথা বলার সাহসও হবে না।”
প্রথমে রাজ্য পুলিশই ঘটনার তদন্ত করছিল। পরে সিআইডির হাতে তদন্তভার যায়। অন্যতম অভিযুক্ত শেখ সুরজকে মুর্শিদাবাদের সুতি থেকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযোগ, সুরজই মুর্শিদাবাদ থেকে শিশুদের পিংলায় নিয়ে আসত। ঘটনার পরই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘ওখানে বিয়েবাড়ির বাজি তৈরি হচ্ছিল।’ যদিও স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ ছিল, বাজির আড়ালে মাইতি বাড়ির ওই জমির কারখানায় বোমা তৈরি হত। ৩ অগস্ট মেদিনীপুর আদালতে চার্জশিট জমা দেয় সিআইডি। চার্জশিটে বেআইনি বাজি কারখানার কথাই উল্লেখ করা হয়। গত ১ ফেব্রুয়ারি স্প্লিমেন্টারি চার্জশিট জমা দেয় সিআইডি। প্রথম চার্জশিটে অভিযুক্তদের তালিকায় রঞ্জন ও সুরজের নাম থাকলেও স্প্লিমেন্টারি চার্জশিটে নিমাইয়ের নামও যোগ হয়।
রঞ্জনের স্ত্রী সীতাদেবীর দাবি, ‘‘ঘটনার দিন আমি ও আমার স্বামী বাড়িতে ছিলাম না। ওঁকে ফাঁসানো হয়েছে।’’ যদিও দাঁতে দাঁত চেপে আজও বিচারের অপেক্ষায় ব্রাহ্মণবাড়। গ্রামের এক বাসিন্দা সনাতন টুডু বলছিলেন, ‘‘হাল্কা ভাবে মামলা সাজানো হয়েছে। তাই ওঁর বাড়ির লোক ভাবছে, এত শিশুর প্রাণ নিয়েও রঞ্জন মাইতি বেরিয়ে আসবে।’’ তিনি বলছেন, ‘‘রঞ্জন ছাড়া পেলে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ও আমাদের জেলে পাঠাবে। আমরা চাই এই শান্তি বজায় থাকুক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy