রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন স্বামী ভবানন্দ। শনিবার রাতে মানিকপাড়ার রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের মঠাধ্যক্ষের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল কোলাহলের শব্দে। ৯২ বছরের এই সন্ন্যাসী ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হতবাক হয়ে যান। মেঘে ঢাকা চাঁদের আবছা আলোয় আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রকাণ্ড এক দাঁতাল হাতি! আর চারপাশে পিলপিল করছে লোকজন।
ভবানন্দ মহারাজের কথায়, “হাতিটা আশ্রমের পাঁচিল ভেঙেছে বটে। তবে স্বভাবে কিন্তু বেশ শান্তই মনে হয়েছে গজরাজকে। লোকজনই তো দেখলাম হাতিটাকে বিরক্ত করছিল। কেউ কেউ লেজ ধরে টানার চেষ্টাও করছিল।”
প্রবীণ এই সন্ন্যাসী দীর্ঘ পাঁচ দশক জঙ্গলমহলে রয়েছেন। হাতির গতিবিধি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল তিনি। তাঁর মতে, খেতের ফসল ও ঘরে মজুত ধান-চালের লোভে হাতি গ্রামে ঢোকে। তবে নিজে থেকে হাতি কখনও ঘনবসতিপূর্ণ শহর বা মফস্সল এলাকায় হানা দেয় না। বনকর্মীদের দাবি, গ্রামবাসীর একাংশ পরিকল্পিতভাবে রেসিডেন্ট হাতিদের তাড়িয়ে নিয়ে শহর অথবা মফস্সল এলাকায় ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। শুক্রবার ভোরে ঝাড়গ্রাম শহরের রাজবাড়িতে একটি রেসিডেন্ট ঢুকে পড়েছিল। একই ভাবে শনিবার রাতে ঝাড়গ্রাম ব্লকের মানিকপাড়ার জমজমাট মফস্সল এলাকায় রেসিডেন্ট দাঁতালটিকে খেদিয়ে ঢোকানো হয়েছে।
বন দফতরের খবর, রাধেশ্যামপুরের দিক থেকে স্থানীয় লোকজনের তাড়া খেয়ে হাতিটি মানিকপাড়া পেপার মিলের রাস্তা ধরেছিল। চারপাশ থেকে লোকজন হাতিটিকে ঘিরে ধরেছিলেন। মরিয়া হাতিটি রামকৃষ্ণ ফুটবল মাঠ হয়ে রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের বেড়া ভেঙে সটান প্রাঙ্গণের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তাড়া খেয়ে হাতিটি আশ্রমের একটি পাঁচিল ভেঙে বেরনোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেদিকে বেরনোর পথ না থাকায় হাতিটি শ্রীরামকৃষ্ণের মন্দিরের রাস্তা ধরে আশ্রমের মূল প্রাঙ্গণে আম্রকুঞ্জে চলে আসে। কিছুক্ষণ প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে থাকার পরে লোকজনের তাড়া খেয়ে হাতিটি শুঁড় দিয়ে আশ্রমের লোহার দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। এরপর মানিকপাড়ার এইচএস স্কুল মাঠ হয়ে হাতিটি লোকালয় থেকে বেরনোর চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু ক্রমাগত পটকার শব্দে, হুলার ছ্যঁাকা খেয়ে হাতিটি একের পর এক গৃহস্থের বাড়ির পাঁচিল ভেঙে বাগানে ঢুকে পড়েছিল।
বনকর্মীদের ব্যাখ্যা, গৃহস্থ-বাগানের গাছগাছালি দেখে হাতিটি জঙ্গলে যাওয়ার পথ ভেবেই গোটা দশেক পাঁচিল ভেঙেছে। মানিকপাড়ার বাসিন্দা ব্যবসায়ী অমর পাল, প্রদ্যোৎ পাল, স্কুল শিক্ষক সুদর্শন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জনা দশেক বাসিন্দার বাড়ির পাঁচিলও ভেঙেছে হাতিটি। কারও লোহার দরজা উপড়ে ফেলে দিয়েছে। উঠোনে হাতি দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে ঘরবন্দি হয়ে থাকেন তাঁরা। লাইব্রেরি রোড ধরে যাওয়ার সময় হাতিটি নেতাজি ক্লাব-মাঠের পাঁচিলও ভেঙে দেয়। মানিকপাড়া নিবেদিতা আশ্রমের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাক্টরেরও ক্ষতি করে দাঁতালটি। হাতিটি কাউকে জখম করেনি। গৃহস্থের বাগানের আম-কাঁঠালও বিশেষ খায়নি। ঘন্টা দেড়েক মানিকপাড়া দাপানোর পরে বনকর্মীদের তাড়া খেয়ে হাতিটি গভীর রাতে বরাশুলির জঙ্গলের দিকে চলে যায়। তবে আতঙ্কিত বাসিন্দাদের প্রশ্ন, “এভাবে রাত বিরেতে আচমকা দাঁতালের হানায় বড় বিপর্যয় ঘটলে তার দায় কে নেবে?”
ঝাড়গ্রামের ডিএফও বাসবরাজ হোলেইচ্চি বলেন, “আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, হাতিটিকে খেদিয়ে মফস্সল এলাকায় ঢোকানো হয়েছিল। এই প্রবণতা ঠিক নয়। গ্রামবাসীদের নিয়ে রেঞ্জ অফিসারকে বৈঠক করতে বলেছি। যাঁরা এই ধরনের কাজ করছেন তাঁদের সতর্ক করা হবে।”