জৈব চাষে লক্ষ্মী লাভ!
রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে তবেই বাড়বে উৎপাদন- এতদিন অধিকাংশ চাষির ধারণা ছিল এমনই। জৈব পদ্ধতিতে চাষ করেও যে ভাল লাভ মিলতে পারে, এ বার চাষিদের সে কথা বোঝাতে উদ্যোগী হল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কৃষি দফতর।
জৈব চাষ প্রসারে গুরুত্ব দিচ্ছে কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকও। এ জন্য সম্প্রতি কেন্দ্রীয় বাজেটে ৪১২ কোটি টাকা বরাদ্দও করা হয়েছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশের প্রায় ৫ লক্ষ একর জমি জৈব চাষের আওতায় আনার কথা ঘোষণা করা হয়েছে বাজেটে। চলতি আর্থিক বছরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বিনপুর-১, ২, নয়াগ্রাম, ঝাড়গ্রাম, গোপীবল্লভপুর-১ ও ডেবরা- এই ছ’টি ব্লকে ২২টি ‘গুচ্ছ’ গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে কৃষি দফতর। এই ‘গুচ্ছ’ কী? যেখানে এক লপ্তে ন্যূনতম ৫০ একর জমি থাকবে। চাষি থাকবেন ন্যূনতম ৫ জন। ওই পরিমাণ জমিতে সরকারি সহায়তায় জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা হবে। সব মিলিয়ে চলতি আর্থিক বছরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ১১০০ একর জমিতে জৈব চাষ করা হবে বলে কৃষি দফতর জানিয়েছে। তিন বছরে এলাকার পরিমাণ আরও বাড়বে।
সাধারণত বেশি ফলনের আশায় চাষিরা জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন। খড়্গপুর আইআইটি-র ফুড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কৃষি বিশেষজ্ঞ বিজয় ঘোষ জানাচ্ছেন, জমিতে রাসায়নিক সার দিলে গাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে। কিন্তু গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না। ফলে জমিতে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। কীটনাশক ব্যবহারের অন্তত ১৫ দিন পর সেই সব সব্জি খেতে হয়। কিন্তু দেখা যায়, কীটনাশক ব্যবহারের ২-৪ দিন পর থেকেই তা বাজারে এসে যায়। সব্জির মধ্য দিয়েই শরীরে ঢোকে বিষ। বিজয়বাবুর কথায়, “জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটিতে অ্যামোনিয়া, নাইট্রেট-নাইট্রোজেনও থেকে যায়। যা জলে মেশে। সেই জল আমরা পান করি। যা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। যার ফলে বাচ্চাদের ‘ব্লু বেবি ডিজিস’ হয়। বড়দের ঘন ঘন অম্বল, টিউমারও হতে পারে।’’
জৈব সার ব্যবহার করলেও কী একইরকম ফলন মিলবে? বিজয়বাবুর কথায়, “এই পদ্ধতিতে ধীরে ধীরে ফলন বাড়বে। তাছাড়া জৈব সার প্রয়োগ করলে মাটির স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হবে।” প্রশ্ন উঠছে, প্রথম দু’তিন বছর ফলন কম হলে আয়ও কমবে। কোনও চাষি কি ক্ষতি স্বীকার করতে রাজি হবেন? কৃষি দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর প্রভাত বসুর কথায়, “এই জন্যই তো প্রথমে সরকার আর্থিক সাহায্য থেকে প্রশিক্ষণ- সবই দেবে। একজন চাষির লাভ হচ্ছে দেখলেই অন্যরাও এই পদ্ধতি ব্যবহারে উৎসাহিত হবেন।”
জৈব পদ্ধতিতে চাষ করে যে লাভ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তার প্রমাণও রয়েছে। লালগড়ের বাঁধগড়া গ্রামের আহ্লাদী সরেন চার বছর ধরে জৈব সার ব্যবহার করে শ্রী পদ্ধতিতে চাষ করছেন। আহ্লাদীদেবীর কথায়, “বাড়িতেই তো কেঁচো আর গোবর দিয়ে জৈব সার বানানো হয়। ফলে খরচ তো নেই বললেই চলে।” জৈব সারে পোকামাকড়ের আক্রমণ হলে উপায় কী? তাঁর কথায়, “বাড়িতেই নিমপাতা, গোবর, গো-মূত্র প্রভৃতি দিয়ে জৈব রসায়ন বানানো হয়। এটিই পোকামাকড়ের অব্যর্থ ওষুধ।”
আহ্লাদীদেবীর ৪ বিঘা জমি রয়েছে। তার মধ্যে ৫ কাঠা জমিতে এই পদ্ধতিতে চাষ শুরু করেন তিনি। আহ্লাদীদেবীর কথায়, “প্রথমবার ভালই লাভ হল। তাই দেখে পরের বছর ১ বিঘা জমিতে জৈব পদ্ধতিতে চাষ করি। এ বছর ৫ কাঠা বাদ দিয়ে ৪ বিঘা জমিতেই ধান চাষ করেছি।’’ তিনি আরও বলছেন, ‘‘আগে যেখানে বিঘা প্রতি বড়জোর ৪ কুইন্টাল ধান পেতাম, সেখানে এখন নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে বিঘা প্রতি সাড়ে ৭ কুইন্টালেরও বেশি ধান পাচ্ছি।” আহ্লাদীদেবীর পাশের গ্রাম ছোটপেলিয়ার কমলা টুডু বলেন, “ওদের গ্রামে গিয়ে এই চাষ শিখে এসেছি। আমিও জৈব পদ্ধতিতে চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
লাভ বেশি হওয়ার কারণ কী? কৃষি আধিকারিক রণজয় পোদ্দার জানাচ্ছেন, ওই এলাকায় মাটি অনুর্বর। তাই বেশি রাসায়নিক সার দিলেও ভাল ফলন মিলত না। উল্টে মাটির স্বাস্থ্যের ক্ষতি হত। কিন্তু জৈব ও শ্রী পদ্ধতির মিশ্রণ ঘটায় ভাল ফল মিলছে। ভাল ফলন হওয়া সত্ত্বেও কেন সকলে এই পদ্ধতিতে চাষ করছেন না। কমলাদেবীর কথায়, “নতুন পদ্ধতি কে শেখাবে? আমরা কী এ সব জানি। নিজের চোখে অন্যদের লাভ করতে দেখে নতুন পদ্ধতি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
কৃষি দফতরের আধিকারিকদের মতে, জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসলের দামও বেশি মিলবে। কিন্তু কোন ফসল যে জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদন হয়েছে তার শংসাপত্র দেবে কে? কৃষি দফতর জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট ব্লকের কৃষি আধিকারিকেরা সেই শংসাপত্র দেবেন। কোনও সংস্থা সেই শংসাপত্র না মানলে পরীক্ষাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করে শংসাপত্র দেওয়া হবে। এই পরীক্ষার জন্য মেদিনীপুরে পরীক্ষাগারও রয়েছে। আর বিজয়বাবু বলছেন, “জৈব সার বাজার থেকে কেনারও প্রয়োজন হবে না। বাড়িতেও জৈব সার তৈরি করা যায়। নিজেরা সার তৈরি করে চাষ করলে খরচও অনেক কমে যাবে।”
তিনি আরও বলছেন, ‘‘বেশি মাত্রায় রাসায়নিক সারের ব্যবহারে মাটির স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হয়। মাটির অম্লত্বও বাড়ে। মাটিতে থাকা উপকারী জীবাণুর মৃত্যু হয়।” আইআইটি-র বিশেষজ্ঞদের মতে, জমিতে যদি কেঁচো না থাকে তাহলে বুঝতে হবে জমি উর্বর নয়। ১ বর্গমিটার জমিতে অন্তত, ৭৫-১০০টি কেঁচো থাকা উচিত। এখন কেঁচোর দেখাই মেলে না। এ ভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে ব্যাঙ, সাপ, মাঠের মাছ আর আকাশের শকুনও। নষ্ট হচ্ছে খাদ্যশৃঙ্খল।
বিজয়বাবু বলছেন, “আজ না হলেও কাল, পুরনো পদ্ধতিতে ফিরতেই হবে। নয়তো মানব সমাজকেই ঘোর সঙ্কটের মুখে পড়তে হবে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য —দুই সরকারেরই এই বিষয়টিকে আরও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy