Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

একার চেষ্টায় স্ট্রবেরি ফলিয়ে দিশা দেখাচ্ছেন সুব্রত

বাবা রাজি ছিলেন না। মেলেনি সরকারি সাহায্যও। একার চেষ্টাতেই নিজেদের ছ’বিঘা জমি থেকে আয় বাড়াতে নতুন কিছু করার পণ করেছিলেন পিংলার গোগ্রামের সুব্রত মহেশ।

গোগ্রামে স্ট্রবেরির খেতে সুব্রত মহেশ। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

গোগ্রামে স্ট্রবেরির খেতে সুব্রত মহেশ। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

সুমন ঘোষ
পিংলা শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৪ ০৪:২১
Share: Save:

বাবা রাজি ছিলেন না।

মেলেনি সরকারি সাহায্যও।

একার চেষ্টাতেই নিজেদের ছ’বিঘা জমি থেকে আয় বাড়াতে নতুন কিছু করার পণ করেছিলেন পিংলার গোগ্রামের সুব্রত মহেশ। রীতিমতো চ্যালেঞ্জ নিয়েই মাত্র চার কাঠা জমিতে স্ট্রবেরি চাষ শুরু করেন তিনি। আর এখন দিনে ৫ হাজার টাকার স্ট্রবেরি বিক্রি করেছেন তিনি! সুব্রতর কথায়, “বাবা-মা প্রথমে কিছুতেই এই চাষ করতে রাজি ছিল না। আমিও নাছোড় ছিলাম। শেষে বাবাকে নিয়ে সোজা নদিয়ায় যাই। সেখানে কৃষি বিশেষজ্ঞ হরিদাস মণ্ডলের কথা সঙ্গে কথা বলানোর পর রাজি করাতে পেরেছি।”

পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা ব্লকের গোগ্রাম নেহাতই গণ্ডগ্রাম। এখানে চাষ বলতে, ধান, সরষে, তিল। কিছু সব্জি ও ফুলচাষও হয়। সুব্রত আগে কখনও ধান, আবার কখনও ফুল চাষ করেছেন। কিন্তু কিছুতেই মন ভরেনি। তাই স্ট্রবেরি। সুব্রতর বাবা পঞ্চাননবাবু অবশ্য স্ট্রবেরি চাষে কিছুতেই রাজি ছিলেন না। তা নিয়ে বাবা-ছেলের বিবাদ চরমে ওঠে। অবশেষে বাবাকে সঙ্গে করে বিশেষজ্ঞের কাছে গেলেন সুব্রত। পঞ্চাননবাবুর কথায়, “বিঘে ছয়েক জমিতে চাষ করে বহু কষ্টে সংসার চলে। হঠাত্‌ কীভাবে ঝুঁকি নিই বলুন তো? তাই প্রথমে ছেলের সঙ্গে অশান্তি করেছিলাম।”

এ দিকে, ছ’বিঘা জমি থেকে আয় বাড়াতে কৃষি দফতরে গিয়ে কোনও সুরাহা হয়নি। পরামর্শ পাওয়া দূর, বেশিরভাগ সময়ে কারও দেখাই মেলেনি। তবু হাল ছাড়েননি সুব্রত। সটান খড়্গপুর গিয়ে আইআইটি-র কৃষি বিভাগে যোগাযোগ করেন তিনি। তারপর থেকে কৃষি সংক্রান্ত আলোচনাসভা হলেই হাজির হতেন বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ সুব্রত। সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় কৃষি দফতরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর (নদিয়ার রানাঘাটে কর্মরত) হরিদাস মণ্ডল ও খড়্গপুর আইআইটি থেকে গবেষণা করা কৃষি বিজ্ঞানী সৌমেন পালিতের সঙ্গে। দু’জনেই সুব্রতকে স্ট্রবেরি চাষে উত্‌সাহিত করেন। রানাঘাটে গিয়ে চাষের পদ্ধতি শিখে আসেন সুব্রত, নিয়ে আসেন চারাও। চার কাঠা জমি চাষ করতে প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। ইতিমধ্যেই সুব্রত ৬০ হাজার টাকার বেশি স্ট্রবেরি বিক্রি করেছেন। এখনও গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১৫ কেজি ফল উত্‌পাদন হয়। ২০০ টাকা কিলোগ্রাম দরে স্ট্রবেরি বিক্রি হচ্ছে। এ ভাবে আরও ২ মাস তা বিক্রি করতে পারবেন। তবে গরম পড়লে ফলে মিষ্টতা থাকবে না। তখন বাজারে স্ট্রবেরির চাহিদা কমবে। হরিদাসবাবুর কথায়, “প্রথম বছরে এই চাষ করতে ১ বিঘেতে ১ লক্ষ ৫ হাজার টাকা খরচ হয়। ৬ মাসে আড়াই লক্ষ টাকার স্ট্রবেরি বিক্রি করতে পারবেন। অর্থাত্‌ প্রায় দেড় লক্ষ টাকা লাভ।” এরপর এলাকা বাড়ালে বিঘা প্রতি ৪০ হাজার টাকা খরচ বাড়বে। কারণ, তখন আর চারা কিনতে হবে না। গাছ থেকেই ‘রানার’ বেরিয়ে নতুন নতুন চারার জন্ম দেবে। এমনকী গ্রামের অন্য কোনও চাষি চাষ করতে চাইলে তাঁকে চারা বিক্রি করেও অতিরিক্ত লাভ পাওয়া যাবে।

তবে স্ট্রবেরি বাজারে বিক্রি করতে গিয়ে বেগ পেতে হয়েছিল সুব্রতকে। গোগ্রামের স্থানীয় বাজারে স্ট্রবেরি নিয়ে যেতেই অনেকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল, এটা কী? খায় না মাথায় দেয়! তারপর মেদিনীপুর বাজারে গিয়েও দিনে ৫-১০ কেজির বেশি স্ট্রবেরি বিক্রি করা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। বিক্রি বাড়াতে সুব্রত ছুটে যায় খড়্গপুরের বিগ বাজারে। হরিদাসবাবুর চেষ্টায় কলকাতাতেও বাজার মিলে যায়। ফলে এখন আর বিক্রির সমস্যা নেই। গোগ্রামের বাসিন্দা অঞ্জলি মহেশ, সাগর পাত্ররা বলেন, “দেখছি কী একটা ফলের চাষ করেছে। বেশ ভালো হচ্ছে। তবে আমরা তো কিছু জানি না। আর বিক্রি করে কেমন লাভ হচ্ছে তা তো বুঝতে পারছি না। তাহলে আমরাও করতে পারতাম।”

শুধু স্ট্রবেরি নয়, এবার প্রায় দেড় কাঠা জমিতে ড্রাগন ফ্রুটও লাগিয়েছেন সুব্রত। পরের বছর এক বিঘা জমিতে স্ট্রবেরি চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে সুব্রতর আক্ষেপ, “এগিয়ে এসে সাহায্য তো দূরের কথা, সমস্যায় পড়লে কৃষি দফতরে গিয়েও কোনও পরামর্শ মেলে না। ব্যস্ত আছি বলে দেখা পর্যন্ত কেউ করে না।” হরিদাসবাবুর কথায়, “রাজ্যের বিভিন্ন জেলার চাষিরা আমার কাছে এসে পরামর্শ নিচ্ছেন। চারারও ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। এভাবেই জেলা জুড়ে স্ট্রবেরি চাষ ছড়িয়ে দেব।”

প্রশ্ন উঠছে, পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও কৃষি ও উদ্যানপালন দফতর স্ট্রবেরি চাষ প্রসারে উদ্যোগী হয় নি কেন? কৃষি দফতরের পিংলা ব্লকের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর বিশ্বজিত্‌ কুইলা বলেন, “স্ট্রবেরি চাষ হয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু এত কাজের চাপ যে গিয়ে দেখা হয়নি!” জেলা উদ্যানপালন আধিকারিক রণজয় দত্তের কথায়, “স্ট্রবেরি চাষ সেভাবে হচ্ছে না। কোথাও কোথাও কেউ করে থাকতে পারেন।” তাঁদের সাফাই, কর্মী সঙ্কটের কারণে এই কাজে তাঁরা মন দিতে পারছেন না। অথচ এই ধরনের নতুন চাষে সরকারিভাবে আর্থিক সাহায্যও মেলে।

এত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন সুব্রতদের মতো ইচ্ছুকদের হন্যে হয়ে ঘুরতে হবে। প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে সেই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE