হলদিয়ার রামচন্দ্রপুরে দলীয় সমর্থকের বাইকে চড়ে বিভিন্ন বুথ ঘুরে দেখছেন তৃণমূল প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
চারটি মোবাইল। একটা ধরতে গেলে আর একটা বেজে উঠছে। এক জনকে থামিয়ে কথা বলতে হচ্ছে আর এক জনের সঙ্গে। কিন্তু ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন বারবার করছেন সকলকেই“লিডটা ধরে রাখতে পারবেন তো?”
গত বার প্রায় পৌনে দু’লক্ষ ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন। পেয়েছিলেন ৫৫ শতাংশের উপরে ভোট। তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী এ বারও নিশ্চিন্ত মনেই বলে দিচ্ছেন, “জিতবই।” কিন্তু তাঁর চ্যালেঞ্জটা যে সেখানে নয়, তা তিনি নিজেও জানেন। লড়াইটা গত বারে তাঁর নিজেরই মার্জিনের সঙ্গে। ৪৪ ডিগ্রির ঠা-ঠা রোদে সুনসান পথঘাট দিয়ে যাওয়ার সময়ে কালো বাতানূকুল গাড়ির ভিতরেও তাই তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মুখে অবশ্য অগাধ আত্মবিশ্বাস। এই গরমেও বুথে বুথে ভোটারদের লাইন। রানিচকে সিপিএমের বন্ধ জোনাল কার্যালয়ের প্রতীকী তিনতলা বাড়িটার মতো ময়দান থেকে বামেরা উধাও। সোমবার সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ হলদিয়া টাউনশিপের মহাপ্রভুচক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে ভোট দেওয়ার পরে গাড়িতে ওঠার সময় মুচকি হেসে বলেছিলেন, “১,৮৫৬ টা বুথের মধ্যে ছ’শো বুথে সিপিএম কোনও এজেন্টই দিতে পারেনি। যেগুলোয় আছে, ভোটের হার দেখে দুপুরের পর নিজেরাই পাততাড়ি গুটিয়ে পালবে। নন্দীগ্রামের রক্ত এখনও ওদের হাতে লেগে রয়েছে।’’
কিন্তু গত বার জোট ছিল। নন্দীগ্রামের স্মৃতিও টাটকা ছিল ভোটারদের মনে। এ বার লক্ষ্মণ শেঠকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে সিপিএম। নন্দীগ্রাম নিয়ে সিবিআইয়ের রিপোর্টও বামেদের কিছুটা অন্তত স্বস্তি দিয়েছে। তাই শুভেন্দু এ বার দলের যে নেতাই ফোন করছেন, তাঁকেই জিজ্ঞাসা করছেন, “আপনার এলাকায় এক নম্বর হবো তো? সব অঙ্ক মিলবে তো?”
সাড়ে আট ঘন্টার সফরে সাতটি বিধানসভার মধ্যে পাঁচটির বিভিন্ন এলাকা ছুঁয়েও যেন স্বস্তিতে নেই তিনি। ফোনে কখনও ‘শীতলদা’কে বলছেন, “আপনি পঞ্চয়েতে লিড দিয়েছিলেন। এবার পরিধিটা আরও বড়। লিডটা ধরে রাখুন।” তারপরেই তমলুক শহর তৃণমূল সভাপতি দিব্যেন্দু রায়কে ফোনে ধরে বললেন, “মানিকতলাটা দেখে নাও। আমি পরে যাচ্ছি।” হলদিয়া টাউনশিপের কয়েকটা বুথ ও দলীয় বুথ ক্যাম্প ঘুরে শুভেন্দু তখন দুর্গাচকে নিজের সাংসদ কার্যালয়ের তিনতলায় অফিস ঘরে। ফের দু’টি কানে ফোন। ফোনে হলদিয়ার এক যুব কংগ্রেস সভাপতির ‘মেসেজ’ এল: ‘জয়ের হাসি দেখতে চাই।’ পরক্ষণেই এক সিপিএম নেতার ফোন। তাঁর কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়েন শুভেন্দু--“অ্যাঁ, বলেন কী, আপনাদের কর্মীদের আমরা খেদিয়ে তুলে দিয়েছি! একথা আলিমুদ্দিনকে জানিয়েছেন, সত্যি!” ফোন রেখে এ বার জোরে শ্বাস ছেড়ে বলেন, “দেখছেন তো? কংগ্রেসের সব ভোট আমাকে দিচ্ছে। সিপিএমের ভোটও পাচ্ছি।”
ঘড়ির কাঁটা দশটা ছাড়াতেই নিজের পুরনো ‘পয়া’ জায়গা গাঁধী ভবনে চলে গেনে। সাংসদ হওয়ার আগে এখানেই বসতেন। সেখানে কর্মীদের সঙ্গে দু’এক কথা সেরে ফের গাড়িতে। বার তিনেক গাড়ি থেকে নেমে নিরাপত্তা রক্ষীদের ছাড়াই দলীয় কর্মীদের মোটরবাইকের পিছনে বসে সরু রাস্তা ধরে পৌঁছে গিয়েছেন ভবানীপুর, সুতাহাটা, রামচন্দ্রপুর, চৈতন্যপুরের একের পর এক বুথে। এরপর গাড়িতে মহিষাদল ও নন্দকুমার যাওয়ার পথেও আবার সেঅ একই প্রশ্ন তাঁর মুখে। উদ্বিগ্ন স্বরে ফের দলের নেতা-কর্মীদের ফোন করে জানতে চেয়েছেন, “গত বারের থেকে ভোটের হার বাড়বে তো!”
গাড়ির পিছনের আসন থেকে নিরাপত্তা কর্মী কৌশিক মণ্ডল কখনও লিকার চা, কখনও ঘোলের শবরত, কখনও আবার গ্লুকোজ জল এগিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু শুভেন্দুর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বলছিল, উত্তর চল্লিশের এই যুবকের ক্লান্তি ও উদ্বেগ যাচ্ছে না! গত বার তিনিই ছিলেন যুব তৃণমূলের মুখ। এ বার সেই জায়গাটা দীপক অধিকারীর অধিকারে। দেবও কি তা হলে শুভেন্দুর প্রতিদ্বন্দ্বী? বিরক্ত শুভেন্দু বলেন, “এ সব প্রশ্নের কোনও জবাব দেব না।”
বেলা গড়ায়। বিকেলে পূর্ব পাঁশকুড়া ও কোলাঘাটের সাতটি বুথ ঘুরে এসে তমলুকের সাংসদ কার্যালয়ে নিজের ঘরে ফিরলেন শুভেন্দু। তারপরে নিশ্চিন্ত গলায় বললেন, “এ বার আলুপোস্ত দিয়ে জলঢালা ভাত খাব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy