Advertisement
E-Paper

জেঠুর আনা লাল চেয়ারে বসে রাজু বললেন, কাজ করব

ডান-বাম মিলিয়ে দিলেন তিনি। সেই মহামিলনের যোগফল? জেঠুর আনা লাল চেয়ার, জেঠিমার ভোট-প্রতিশ্রুতি আর সেই সঙ্গে বৌদির হাতের হালুয়া বরাবরের বামপন্থী বাড়ির ছেলে কেন তৃণমূলের টিকিটে ভোটে দাঁড়াচ্ছে, এ নিয়ে শোরগোলের অন্ত ছিল না। সিপিএম নেতা জেঠুর গলায় খানিকটা অভিমানও ছিল।

সুমন ঘোষ

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৪ ০৩:১০
মতে বিরোধ, মনে নয়। প্রার্থী হওয়ার পর প্রথম ঘরে ফেরা। কেশপুরের মহিষদায় গ্রামের বাড়িতে জেঠু-জেঠিমার সঙ্গে খোশমেজাজে দেব। জেঠু শক্তিপদ অধিকারী এলাকার সিপিএম নেতা। তৃণমূল প্রার্থী ভাইপো কিন্তু আদরে অকৃপণ।  ছবি: কিংশুক আইচ।

মতে বিরোধ, মনে নয়। প্রার্থী হওয়ার পর প্রথম ঘরে ফেরা। কেশপুরের মহিষদায় গ্রামের বাড়িতে জেঠু-জেঠিমার সঙ্গে খোশমেজাজে দেব। জেঠু শক্তিপদ অধিকারী এলাকার সিপিএম নেতা। তৃণমূল প্রার্থী ভাইপো কিন্তু আদরে অকৃপণ। ছবি: কিংশুক আইচ।

ডান-বাম মিলিয়ে দিলেন তিনি।

সেই মহামিলনের যোগফল? জেঠুর আনা লাল চেয়ার, জেঠিমার ভোট-প্রতিশ্রুতি আর সেই সঙ্গে বৌদির হাতের হালুয়া।

বরাবরের বামপন্থী বাড়ির ছেলে কেন তৃণমূলের টিকিটে ভোটে দাঁড়াচ্ছে, এ নিয়ে শোরগোলের অন্ত ছিল না। সিপিএম নেতা জেঠুর গলায় খানিকটা অভিমানও ছিল। সে সব সামলে বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যায় একেবারে ‘লে ছক্কা’ হাঁকালেন দেব। ঘাটালের তৃণমূল বিধায়ক শঙ্কর দলুইকে ডান দিকে আর জেঠু শক্তিপদ অধিকারীকে বাঁ দিকে নিয়ে কেশপুরের গ্রামের বাড়ি থেকেই পুরোদস্তুর জনসংযোগ শুরু করে দিলেন তিনি। ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের তারকা প্রার্থী দোতলা মাটির বাড়ির দাওয়ায় বসে বললেন, “প্রচুর খেটে এই জায়গায় এসেছি। রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে মানুষের জন্যও সে ভাবে কাজ করব।”

ভাইপোর কথা শুনে মাথা নাড়লেন সিপিএমের কেশপুর জোনাল কমিটির সদস্য শক্তিপদবাবু। ধর্ম-সংকট কাটিয়ে এ দিন তিনি ধর্ম আর জিরাফকে একত্র করতে পেরেছেন। ক’দিন আগেই দেবের প্রতিপক্ষ ঘাটাল কেন্দ্রের বাম প্রার্থী সন্তোষ রাণার সমর্থনে মিছিলে হেঁটেছেন শক্তিপদবাবু। এ দিন তিনি বললেন, “বাড়ির ছেলের সঙ্গে তো থাকতেই হবে। কিন্তু তাই বলে দলের সঙ্গে বেইমানি করতে পারব না।” বাড়িতে লোকজন আসবে বলে গোটা পঁচিশেক চেয়ার আনা হয়েছিল। শক্তিপদবাবু ডেকরটেরকে পইপই করে বলে দেন, চেয়ারের রং যেন লাল হয়। শক্তিপদবাবুর সোজা কথা, “আমি যত দিন বাঁচব লালই আমার রং।” লাল জুতোর গান গাওয়া দেব এ দিন সেই লাল চেয়ারে বসেই ঘাসফুলের প্রচার করলেন। আর জেঠিমা দুর্গাদেবী খোলাখুলি বলেই দিলেন, “বাড়ির ছেলেকেই ভোটটা দেব।”

আর জেঠু? অন্য দলে দাঁড়ালেও ভাইপোর জন্য শক্তিপদবাবুর পরামর্শ, “রাজনীতি করলে মন দিয়ে করতে হবে। যাতে লোকে পাঁচ বছর পরে বলতে না পারে, জেতার পরে এক বারও এলাকায় এল না, কোনও কাজ করল না।”

ঘাটাল কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণার পরে এ দিনই প্রথম দেশের বাড়িতে এলেন ‘রাজু’। দেবের পিতৃপুরুষের গ্রাম কেশপুরের মহিষদা তাঁকে ওই নামেই চেনে। একটি বাংলা ছবির শু্যটিংয়ের জন্য ক’দিন হল চন্দ্রকোনা রোডের ফিল্মসিটিতে রয়েছেন তিনি। শু্যটিংয়ের ফাঁকেই মঙ্গলবার মেদিনীপুরে এসেছিলেন তৃণমূলের কর্মিসভায় যোগ দিতে। সে দিন বাড়ি আসা হয়নি। বৃহস্পতিবার বিকেলে তাই শু্যটিং মিটতেই কেশপুর রওনা দেন খোকাবাবু।

খোকাবাবুর ঘরে ফেরা। দেবকে বরণ
করে নিলেন জেঠিমা দুর্গা অধিকারী।

ঘাটালে তারকা প্রার্থীর সমর্থনে
দেওয়াল লিখন । নিজস্ব চিত্র।

তাঁকে দেখতে ভিড়, মানুষের উন্মাদনা নতুন নয়। তবে এখন তো তিনি আর শুধু চিত্রতারকা নন, রাজনীতিরও তারকা। তাই দলের আবদারও রাখতে হয়। মহিষদায় ঢোকার আগে কেশপুর বাসস্ট্যান্ডে ছোটখাটো সভার আয়োজন করেছিল তৃণমূল। বিকেল পাঁচটা কুড়ি নাগাদ দুধ সাদা গাড়িটা কেশপুরে ঢুকতেই উত্তাল হয়ে ওঠে আশপাশ। মুখে মুখে রটে যায়, দেব এসে গিয়েছে। মঞ্চে সাদা শার্ট আর কালো ট্রাউজার্সে স্বপ্নের নায়ককে দেখে হাততালিতে ফেটে পড়ে চার পাশ।

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। তাই মঞ্চে মাইক ছিল না। দেবও মিনিট দশেকের মধ্যে বক্তব্য সেরে ফেলেন। পরীক্ষার্থীদের শুভেচ্ছাও জানান। বলতে উঠে গোড়াতেই মনে করিয়েদেন, “ভোট চাইতে আসিনি। গ্রামের ছেলে, গ্রামে এসেছি। আপনারা সব এলাকার লোক। একবার দেখা করে নিলাম।” তবে এলাকাবাসীর আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা যে তাঁর কাঙ্ক্ষিত, তা জানাতে ভোলেননি দেব।

সভা সেরে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে ছ’টা বেজে যায়। গ্রামে ঢোকার মুখে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন রাজু। শক্তিপদবাবু রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম সারেন দেব। শক্তিপদবাবুও ভাইপোকে বুকে টেনে নেন। তারপর গাঁয়ের পথ ধরে প্রায় তিনশো মিটার হেঁটেই বাড়ি পৌঁছন জেঠু-ভাইপো। পুলিশি নিরাপত্তার মাঝেও উৎসাহী গ্রামবাসীদের নিরাশ করেননি ভূমিপুত্র। গুরুজনদের দেখে করজোড়ে নমস্কার করেছেন। অল্পবয়সীদের দেখে হাত নেড়েছেন। বাড়ির দোরগোড়ায় বরণডালা নিয়ে হাজির ছিলেন জেঠিমা দুর্গাদেবী এবং বৌদি কৃষ্ণা। কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা দিয়ে, গলায় রজনীগন্ধার মালা পরিয়ে আদরের রাজুকে বরণ করে নেন তাঁরা। জেঠিমাকে প্রণাম করে বাড়ি ঢুকে পড়েন দেব।

মহিষদার বাড়িতে তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছিল সকাল থেকে। এই বাড়িতে শক্তিপদবাবু ও তাঁর স্ত্রী দুর্গাদেবী থাকেন। ভাই আসার খবর পেয়ে মেদিনীপুর থেকে এসেছিলেন দেবের জেঠতুতো দাদা সুজিত, বৌদি কৃষ্ণা। ঝাড়গ্রাম থেকে এসেছিলেন দেবের জেঠতুতো দিদি ছায়া দাস এবং ভাগ্নে প্রতীক। দেওরের পছন্দের খাবার রান্নার ভার ছিল কৃষ্ণার উপরে। দেবের বৌদি বললেন, “রাজু নিজে ফোন করে হাতে গড়া রুটি, দেশি মুরগির ঝোল, চিংড়ির মালাইকারি আর পোস্তর বড়া খেতে চেয়েছে। আর অবশ্যই ওর পছন্দের গাজরের হালুয়া। সব আয়োজনই করেছি।”

খুনসুটি। মহিষদায় গ্রামের বাড়িতে জেঠিমা দুর্গা
অধিকারীর সঙ্গে ঘরোয়া মেজাজে দেব।

সকলের সামনেই বৌদির হাত থেকে গাজরের হালুয়া খেলেন দেব। পরম তৃপ্তিতে সুপারস্টারের দু’চোখ বুজে আসছিল। ডায়েটিং তখন মাথায় উঠেছে। উৎসুক সাংবাদিক আর আলোকচিত্রীদের সামনেই তাই বলে ফেললেন, “আপনারা প্লিজ বাইরে যান। আমি তো বাড়িতে এসেছি। খাওয়া-দাওয়া করব তো একটু।” পরিবার সূত্রে পরে জানা গিয়েছে, মাটিতে বসে স্টিলের থালাতেই খেয়েছেন আদরের রাজু।

সন্ধে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত ছিলেন কেশপুরের কৃতী ছেলে। গাড়িতে ওঠার সময় ভিড়ের উদ্দেশে নমস্কার করলেন। মুখে চওড়া হাসি। জেঠু-জেঠিমাকে বললেন, “মন খারাপ কোরো না। প্রচারে তো আসতেই হবে। সুযোগ পেলেই বাড়ি আসব।”

keshpur dev suman ghosh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy