Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

জবরদখল আর জঞ্জালে অতিষ্ঠ পর্যটকরা

বছর পনেরো আগেও ছবিটা ছিল অন্য। তখন কলকাতা থেকে দিঘা আসার ঝক্কি কম ছিল না। ট্রেনে করে মেচেদায় এসে বাস অথবা কলকাতা থেকে টানা বাস বা গাড়ি করে দিঘায় আসা ছিল সময়সাপেক্ষও। সৈকত শহরে গুটিকয়েক হোটেলে পুজো বা ছুটির দিন ছাড়া অন্য সময় ভিড়ও হত নগন্য। কলকাতা থেকে সরাসরি ট্রেন পরিষেবা চালু হওয়ার পর ছবিটা বদলেছে। এখন অবশ্য দিঘার সৈকত প্রায় সারাবছরই গমগম করে আট থেকে আশির কলরবে।

সৈকতের ধার জবরদখল করে গজিয়ে উঠেছে দোকান।

সৈকতের ধার জবরদখল করে গজিয়ে উঠেছে দোকান।

সুব্রত গুহ
দিঘা শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:৫৭
Share: Save:

বছর পনেরো আগেও ছবিটা ছিল অন্য। তখন কলকাতা থেকে দিঘা আসার ঝক্কি কম ছিল না। ট্রেনে করে মেচেদায় এসে বাস অথবা কলকাতা থেকে টানা বাস বা গাড়ি করে দিঘায় আসা ছিল সময়সাপেক্ষও। সৈকত শহরে গুটিকয়েক হোটেলে পুজো বা ছুটির দিন ছাড়া অন্য সময় ভিড়ও হত নগন্য। কলকাতা থেকে সরাসরি ট্রেন পরিষেবা চালু হওয়ার পর ছবিটা বদলেছে। এখন অবশ্য দিঘার সৈকত প্রায় সারাবছরই গমগম করে আট থেকে আশির কলরবে। দিঘায় বর্তমানে হোটেলের সংখ্যাও চারশো ছাড়িয়েছে। রাজ্যে পালাবদলের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিঘাকে গোয়ার ধাঁচে গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করেছিলেন। সেই মতো শহরকে সাজানোর কাজও শুরু হয়েছে। তবে পর্যটনের প্রসার ঘটলেও দিঘা শহরে কোনও সুষ্ঠু নিকাশি ব্যবস্থা না থাকায় নোংরা জল থেকে ছড়াচ্ছে দূষণ। শহরের বিভিন্ন অংশে নিকাশির কাজের জন্য খোঁড়া গর্তে পথ চলা দুষ্কর। হকারদের দাপটে ক্রমে সঙ্কীর্ণ হচ্ছে শহরের রাস্তা।

সৌন্দর্যায়নের জন্য শহর জুড়ে বসেছে ত্রিফলা আলো। সম্প্রতি কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি হয়েছে দিঘার প্রবেশ তোরণ। তৈরি হয়েছে বাইপাস রোড, বাসস্ট্যান্ড, সমুদ্রপাড়ে সুলভ শৌচালয়ও। ‘ওয়াচ টাওয়ার’, ‘ওপেন থিয়েটার’, ‘রোপওয়ে’, ভাঙন প্রতিরোধে সমুদ্র বাঁধ নির্মাণের কাজও চলছে। তবে নিকাশির অভাবে নোংরা জল থেকে ছড়াচ্ছে দূষণ।

বিশ্বব্যাঙ্কের আর্থিক সাহায্যে দিঘায় নিকাশি সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছিল। ঠিক ছিল, চলতি বছরের মার্চ মাসে এই কাজ শেষ করত হবে। কিন্তু মাঝপথে ঠিকাদার সংস্থা কাজ ছেড়ে চলে যাওয়ায় খোঁড়াচ্ছে নিকাশি প্রকল্পের কাজও। নিকাশি প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আবর্জনায় ভরেছে অসমাপ্ত নিকাশি নালাগুলি। নতুন নিকাশি নালা তৈরির জন্য শহরের বিভিন্ন অংশে খোঁড়াখুঁড়িও হয়েছে বিস্তর। ফলে স্থানীয় বাসিন্দা থেকে পর্যটকেরা- পথ চলতে সমস্যায় পড়ছেন সকলেই। দিঘার হোটেল ওনার্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিমাংশু প্রধান অভিযোগ করেন, পযর্টন কেন্দ্র হওয়া সত্বেও আজ পর্যন্ত দিঘা শহরে কোনও নিকাশি ব্যবস্থা নেই। নালার অভাবে হোটেল, লজ-সহ শহরের বর্জ্য ও নোংরা জল রাস্তায় বা হোটেলের ধারেই জমা হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন নোংরা জল জমে থাকায় বাড়ছে মশার উপদ্রবও।

শহরে যত্রতত্র আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখে বিরক্ত দিঘায় বেড়াতে আসা পুরুলিয়ার আদ্রার বাসিন্দা শিপ্রা দত্তগুপ্ত, বর্ধমানের পূর্ণিমা রায়। তাঁদের অভিযোগ, “একটা পর্যটন কেন্দ্রের রাস্তা এমন আবর্জনাময় হতে পারে, দিঘায় না এলে বুঝতেই পারতাম না।” কলকাতার বেহালার বনমালি নস্কর রোড থেকে স্ত্রী, পুত্র ও বউমার সঙ্গে দিঘায় বেড়াতে এসেছিলেন শঙ্কর ঘোষদস্তিদার। শঙ্করবাবুর কথায়, “কয়েকদিনের জন্য দিঘায় এসে একটি হোটেলে উঠেছি। কিন্তু হোটেলের এক তলার জানালা খুলতেই বাইরের আবর্জনার গন্ধে ঘরে থাকাই দুষ্কর হয়ে উঠেছে।” তাছাড়াও পর্যটকদের অভিযোগ, সরকারি নির্দেশ সত্বেও এখনও অনেক হোটেল মালিক রিসেপশনে ঘর ভাড়ার তালিকা ঝুলিয়ে রাখেন না। পর্যটকদের ভিড়ে বেশি ভাড়ার অভিযোগও ওঠে।

আবর্জনার স্তূপ দিঘার রাস্তাঘাটে।

স্বাধীনতার পর পঞ্চাশের দশকে দিঘাকে সৈকত পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার ১১০০ একর জমি অধিগ্রহণ করে। রাজ্যের উন্নয়ন ও পরিকল্পনা দফতরের হাতে তুলে দেওয়া হয় দিঘার সৌন্দর্যায়ন ও আধুনিকীকরণের দায়িত্ব। দিঘায় আসা পর্যটকদের থাকা ও রাত্রিবাসের জন্য ট্যুরিস্ট কটেজ ও সৈকতাবাস তৈরি করা হয়। এ ছাড়াও রাজ্য পর্যটন উন্নয়ন নিগমের পক্ষ থেকে ট্যুরিস্ট লজ তৈরি করা হয়। গত পঞ্চাশ বছরে দিঘায় গড়ে উঠেছে যুব আবাস থেকে নানা বাংলো ও অতিথিশালা। তবে দীর্ঘদিন সুষ্ঠু পরিষেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিতই থেকেছে শহরের বাসিন্দারা।

বর্তমানে নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। তবে এখনও শহরে ঢুকলেই চোখে পড়বে, অসংখ্য জবলদখলকারীদের দাপটে ক্রমে সঙ্কীর্ণ হচ্ছে রাস্তা। ওল্ড দিঘার শনি মন্দির, দিশারী মাঠ, শিবালয় রোড, নেহরু মার্কেট, দিঘা থানার সামনে দিয়ে হাসপাতল পর্যন্ত রাস্তা, নিউ দিঘার অমরাবতী পার্ক, হলিডে হোম সেকটর থেকে ক্ষণিকা ঘাট যাওয়ার রাস্তা- সর্বত্রই জবরদখলের একই ছবি। ওল্ড দিঘায় ‘দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদ’ (ডিএসডিএ)-এর অফিস লাগোয়া দিশারী মাঠের জমি জবরদখল করে গড়ে উঠেছে বস্তি।

ডিএসডিএ সূত্রে জানা গিয়েছে, ওল্ড দিঘায় সৈকতাবাসের সামনে সৈকতের ধারেই ৪০টির বেশি স্টল তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিন্তু শেষ বার দিঘায় এসে মুখ্যমন্ত্রী সৈকতের ধারে স্টল তৈরির কাজ দেখে তা অন্যত্র সরাতে বলেন। এই পরিস্থিতিতে চলতি বছরের মার্চ মাসের মধ্যে হকার পুনর্বাসনের কাজ শেষ করা নিয়ে আশঙ্কায় প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশই। এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি ডিএসডিএ-র নির্বাহী আধিকারিক সুজন দত্ত।

ব্যবসায়ী ও হকারদের পক্ষে নিত্যগোপাল জানা জানিয়েছেন, ডিএসডিএ যে ভাবে স্টল বানানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন, তাতে যে সব ব্যবসায়ীরা সামুদ্রিক জিনিস দিয়ে তৈরি শৌখিন সামগ্রী বিক্রি করে থাকেন, তাঁরা সমস্যায় পড়বেন। ডিএসডিএ-র অন্যতম সদস্য তথা জেলা মৎস্য কর্মাধ্যক্ষ দেবব্রত দাস জানান, হকারদের জন্য যে ধরনের স্টল তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, সেখানে সামুদ্রিক শৌখিন জিনিসপত্র বিক্রি করাটা অসুবিধাজনক। হকারদের সঙ্গে বৈঠকের পর নতুন করে স্টল তৈরির নকশা তৈরি ও তা বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এমনকী স্টল তৈরির সময় উচ্ছেদ হওয়া হকারদের জন্য অন্যত্র সাময়িক পুনর্বাসন দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ডিএসডিএ-র চেয়ারম্যান তথা কাঁথির সাংসদ শিশির অধিকারীর বক্তব্য, “গত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে দিঘাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী হয়েই দিঘাকে রেলের মানচিত্রে আনা ও মুখ্যমন্ত্রী হয়ে দিঘার উন্নয়নের যাবতীয় পরিকল্পনা নিয়েছেন। দিঘাকে আধুনিক করে গড়ে তুলতে সমুদ্র ভাঙন রোধ, দিঘা থেকে মন্দারমণি পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভের আদলে রাস্তা তৈরি, তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। আরও বিভিন্ন কাজ হচ্ছে।” তিনি বলেন, “দীর্ঘদিনের অবহেলায় দিঘায় নানা সমস্যা রয়েছে। রাতারাতি তা কাটিয়ে উন্নয়ন সম্ভব নয়, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য একটু সময় লাগছে।”

ছবি: সোহম গুহ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE