এভাবেই হুকিং করে চাহিদা মেটে বিদ্যুতের। —নিজস্ব চিত্র।
একুশ বছরের পুরনো পুর-এলাকা। কিন্তু, জনপদের প্রায় তিরিশ শতাংশ বাড়িতে আলো জ্বালাতে ভরসা বিদ্যুতের খুঁটিতে হুকিং!
কুড়ি বর্গ কিলোমিটারের এগরা শহরে রয়েছে ১৪টি ওয়ার্ড। এর মধ্যে ২, ৪ এবং ৮ নম্বর ওয়ার্ডে হুকিং তুলনামূলক ভাবে বেশি। এলাকাগুলি ঘুরলেই দেখা যাবে, বিদ্যুত্ চুরির বহর। আঁকশি লাগিয়ে কোনও কোনও খুঁটি সংলগ্ন তার থেকে কুড়ি-পঁচিশটি পর্যন্ত বেআইনি সংযোগ চলে গিয়েছে বাড়িতে। মানছেন চার নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর তথা পুরসভার প্রাক্তন উপ-পুরপ্রধান বীরেন নায়ক। কিন্তু, বিদ্যুত্ চুরি কেন?
প্রশ্নটা করতেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন বছর ষাটের এক প্রৌঢ়। ক্ষোভের সঙ্গে যা বললেন, তার সারমর্ম: বিদ্যুত্ চুরিতে সায় মন দেয় না। কিন্তু উপায়ও নেই। কেননা, পুরসভার কাছে বিদ্যুতের দাবিতে দফায় দফায় কয়েক বছর ধরে দরবার করছেন। স্থানীয় কাউন্সিলরকে জানিয়েছেন। কিন্তু, পুর-কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে এখনও বিদ্যুত্ আসেনি। তাই বলে বিদ্যুত্ চুরি? মাথা নীচু করে প্রৌঢ়ের জবাব, “জানি অন্যায় করছি। এ ছাড়া উপায়ই কি?” সহমত অন্যেরাও।
এগরা মহকুমার বিদ্যুত্ দফতরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ইজ্ঞিনিয়ার তথা পুর এলাকার দায়িত্বে থাকা বিদ্যুত্ কর্তা এম.কে.মণ্ডল পুর বাসিন্দাদের উপরেই বিদ্যুত্ চুরির যাবতীয় দায় চাপিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলছেন, “পুর এলাকার বেশ কিছু ওয়ার্ড থেকে অনেকেই এখনও বিদ্যুত্ চেয়ে আবেদন করেননি। যাঁরা আবেদন করেছেন, তাঁদের অনেকে আবার আইনি বিদ্যুত্ সংযোগ নিতে উত্সাহী নন।” তা হলে বিদ্যুত্ চুরি ঠেকাতে অভিযান চালানো হয় না কেন? এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে চাননি। তবে বিদ্যুত্ দফতরের এক আধিকারিকের জবাব, হুকিং খুলতে গেলে আক্রান্ত হওয়ায় ‘ভয়’ থাকে। পুলিশের উপস্থিতিতে এ বার অভিযান চালানো হবে, বলছেন তিনি।
বিদ্যুত্ ছাড়াও পুর-পরিষেবার প্রশ্নে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে এগরাবাসীর। ক্ষোভের সঙ্গে অনেকেই জানাচ্ছেন, পুর এলাকার ন্যূনতম চাহিদা যেমন পরিশ্রুত পানীয় জল, নাকাশি, রাস্তায় বাতি, খেলার বা প্রাতঃভ্রমণের উপযুক্ত মাঠ, শিশু উদ্যান মায় কমিউনিটি হল কোনওটাই নেই। পুর-কর্তৃপক্ষের হিসেবেই প্রায় আট শতাংশ রাস্তা এখনও মাটির। ঢালাই-পিচের রাস্তা মিলিয়ে রয়েছে পঁচিশ শতাংশের মতো। আর বাকিটা মোরামের। যার অধিকাংশ আবার বেহাল!
এগরা পুরসভায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর প্রথমে ক্ষমতাসীন ছিলেন বামেরা। তবে শেষ পনেরো বছর পুরবোর্ড ছিল কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের দখলে। কিন্তু, কেউই পরিষেবার মানোন্নয়নে উদ্যোগী হয়নি বলে অভিযোগ। নতুন বছরে ভোট রয়েছে এগরা পুরসভায়। তার আগে ডান-বাম সব দলকেই পরিষেবার মান নিয়ে নানা প্রশ্নে নাজেহাল হতে হবে, মত পুরবাসীর একটা বড় অংশের।
এক নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা দেবাশিস জানা। তিনি বলেন, “এগরা হাইস্কুলের শিক্ষক হিসেবে এসে এখানেই ঘরবাড়ি বানিয়েছি। এলাকাটি পুরসভা হওয়ায় ভেবেছিলাম পরিষেবা নিয়ে হয়ত কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু, এখনও বর্ষার সময়ে কাদা-জল পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে হয়।” রাস্তাঘাট, পানীয় জলের পরিষেবার যখন এই হাল তখন আধুনিক পরিষেবা তো দিবাস্বপ্ন, বলছেন চোদ্দ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা স্বপন বারিক।
পুরসভার নিজস্ব কোনও কমিউনিটি হল নেই। যেখানে নাটক-নাচ-গান কিংবা কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ হবে। এলাকায় রয়েছে ‘কৃষ্টিচক্র’-এর মতো নাট্যদল। সংস্থার সম্পাদক শুভাশিস মাইতি বলছেন, “কমিউনিটি হল না থাকায় ম্যারাপ বেঁধে নাটক করতে হয়। তাতে নাটকের মান ভাল করা যায় না।” বহু বছর ধরে আবেদন করেও কোনও সুরুাহা হয়নি, ক্ষোভ তাঁর।
সম্প্রতি পুরসভা বাড়ি বাড়ি পানীয় জল পৌঁছে দিতে উদ্যোগী হয়েছে। শুরু হয়েছে পাইপ লাইন বসানোর কাজ। কিন্তু, সে কাজ ঢিমেতালে চলার অভিযোগ যেমন রয়েছে, তেমনি পুরবাসী প্রশ্ন তুলছেন কাজের মান নিয়েও। নানাবিধ অভিযোগ পেয়ে সম্প্রতি পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক অন্তরা আচার্য এ বিষয়ে পুর-ইজ্ঞিনিয়ারকে ভত্সর্নাও করে দ্রুত কাজ শেষের নির্দেশ দেন।
এমন পুর-শহরেরও জমির দাম কিন্তু বিপুল হারে বাড়ছে। এগরা পুরসভায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকেই জমির দামের এই উর্ধ্বগতি বলে বলছেন বাসিন্দারা। এগরা বাজার সংলগ্ন এলাকা, এক নম্বর ওয়ার্ডের পটলাইকা ইত্যাদি এলাকায় রাস্তার ধারে জমির দাম বর্তমানে ডেসিমেল প্রতি প্রায় পনেরো লক্ষ টাকা! এগরার ভৌগলিক অবস্থান মেদিনীপুর, পটাশপুর, দীঘা, কাঁথির ঠিক মাঝে। অবস্থানগত সুবিধের জন্য আশপাশের এলাকার মানুষ এগরাকে বসবাসের জায়গা হিসেবে বেছে নেন।
কিন্তু, পুর-এলাকার প্রায় তিরিশ শতাংশ এলাকায় এখনও কেন বিদ্যুত্ নেই? প্রাক্তন পুরপ্রধান তৃণমূলের স্বপন নায়েকের জবাব, “বিদ্যুদয়নের সমস্যার জন্য দায়ী বিদ্যুত্ দফতরের গাফিলতি।” অন্য পরিষেবা? স্বপনবাবুর দাবি, রাস্তাঘাট-পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার কাজ তাঁর আমলেই শুরু হয়েছে। নির্বাচনে জিতলে বাকি কাজও দ্রুত শেষ করবেন। যে কাজ এত দিনেও হয়নি, পরের বার কি সব করা সম্ভব? নিরুত্তর প্রাক্তন পুরপ্রধান। পুর-কর্তৃপক্ষের গড়িমসিতেই কাজ সময়ে হয় না, বলছেন পুরসভার বিরোধী দলনেতা সিপিএমের সুব্রত পণ্ডা। তাঁর কথায়, “সব ক্ষেত্রেই ব্যর্থ পুরসভা।”
পুরসভা বর্তমানে মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় পুরসভার অন্যতম প্রশাসক হিসেবে রয়েছেন মহকুমাশাসক অসীমকুমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, “অল্প সময় হল এসেছি। ইতিমধ্যে বিদ্যুতের সমস্যার বিষয়টি শুনেছি। আবেদনকারীদের তালিকা তৈরি করে দ্রুত বিদ্যুদয়নের নির্দেশ দিয়েছি।”
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু
বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
subject-এ লিখুন ‘আমার শহর মেদিনীপুর’। ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান:
www.facebook.com/anandabazar.abp অথবা চিঠি পাঠান
‘আমার শহর’, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর বিভাগ,
জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy