আট ওয়ার্ডের ঝাড়গ্রাম পুর-এলাকার আয়তন আড়ে বহরে বেড়ে এখন ২১.০৪ বর্গ কিলোমিটার। শহরের দক্ষিণপ্রান্ত সারদাপীঠ মোড় থেকে উত্তরপ্রান্ত জামদা এলাকার দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। অথচ এমন শহরে বাসিন্দাদের নিজস্ব সাইকেল ও মোটরবাইক ছাড়া পরিবহণ বলতে শুধুই ভরসা রিকশা। হাতে গোনা যে কয়েকটি অটো রয়েছে, তারা মূলত শহর থেকে গ্রামীণ এলাকার মধ্যে যাত্রী পরিবহণ করে। ৬৩ হাজার জনসংখ্যার এই শহরে এখনও চালু হয়নি অটোও। নেই টাউন বাস-সার্ভিসও। ফলে অরণ্য শহরের পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে শহরের বাসিন্দাদের।
শহরের উত্তর প্রান্তের বাছুরডোবা থেকে থেকে দক্ষিণ প্রান্তের মধুবন এলাকাটি ৫৫ ফুট উঁচু। ফলে শহরের পরিবহণের প্রধান যে মাধ্যম, সেই রিকশা টানতে চালকের যেমন কালঘাম ছোটে, তেমনই আরোহীকে ভাড়াও গুনতে হয় দেদার। রিকশার কোনও নির্দিষ্ট দর নেই যে। শহরের প্রবীণ বাসিন্দা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “ঝাড়গ্রাম শহর যেভাবে বেড়ে উঠছে, তাতে অবিলম্বে শহরের মধ্যে বিভিন্ন রুটে অটো সার্ভিস চালু করা উচিত। রিকশার ভাড়াও অত্যন্ত বেশি। রাত ৮টার পর রিকশা পাওয়া যায় না।” শহরের বাসিন্দা পেশায় শিক্ষিকা সুস্মিতা ঘোষ মণ্ডলের কথায়, “ঝাড়গ্রামে অটো সার্ভিস থাকলে নিত্যদিনের পরিবহণ খরচা অনেকটা কমত। আমার বড়ি থেকে রিকশায় স্কুল যেতে এক পিঠেই ৫০ টাকা ভাড়া গুনতে হয়। এমন সমস্যার জন্য আমি বাধ্য হয়ে নিজে স্কুটি চালিয়েই যাতায়াত করি।” বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রতিদিনই গ্রামাঞ্চল থেকে মহকুমা সদর শহরে আসেন অনেকেই। সমস্যায় পড়তে হয় তাঁদেরও। অটো সার্ভিস না থাকায় সমস্যা পড়েন অরশ্যশহরে আসা পর্যটকেরাও। তবে সকলেরই মত, গ্যাস চালিত দূষণ মুক্ত অটো সার্ভিস চালু হোক অরণ্যশহরে।
এক সময় শহরেরবড় সমস্যা ছিল মেন রোড সংলগ্ন রেল ক্রশিংয়ে যানজট। অরণ্যশহর থেকে বেলপাহাড়ি ও বাঁকুড়াগামী এই মেন রোডটি রাজ্য সড়ক। তৃণমূলের সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে ২০১১ সালে শহরের রেলওয়ে ক্রসিং সংলগ্ন মেন রোডে উড়ালপুল তৈরি শুরু হয়। রেল ও রাজ্য সরকারের বরাদ্দকৃত টাকায় কাজের দায়িত্ব নেয় রেল। রেলের তরফেই টেন্ডার ডেকে একটি ঠিকাদার সংস্থাকে নিয়োগ করা হয়। সিদ্ধান্ত ছিল, ১৮ মাসের মধ্যে উড়ালপুল তৈরির কাজ শেষ হবে। তিন বছর কেটে গেলেও চালু হয় নি উড়ালপুল। এখন শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে। প্রশাসনিক মহলের আশ্বাস, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে উড়ালপুলটি চালু হয়ে যাবে। উড়ালপুল তৈরির জন্য শহরের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তের মধ্যে সরাসরি সংযোগ গত তিন বছর ধরে বিচ্ছিন্ন। ঘুরপথে কদমকানন রেল ক্রসিং ও বামদা রেল ক্রসিং দিয়ে এখন যান চলাচল করে। ফলে যেমন সময় লাগে বেশি, তেমনই সরু রাস্তায় দুর্ভোগও পোহাতে হয়।
অরণ্যশহরে তিন দশকের বাম জমানার অবসান ঘটিয়ে গত বছর নভেম্বরে পুরসভার দখল নিয়েছে তৃণমূল। আশা ছিল, পূর্বতন বাম পুরবোর্ড যা করতে পারে নি, তা করে দেখাবে তৃণমূলের বর্তমান ক্ষমতাসীন বোর্ড। কিন্তু নতুন পুরবোর্ড দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরে তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে কই? পর্যটন-শহর ঝাড়গ্রামে খন্দপথে প্রলেপ দেওয়ার পাশাপাশি, কিছু রাস্তার কাজ অবশ্য হচ্ছে, তাতে পরিবহণ সমস্যা মেটার আশা দেখছেন না পুরবাসীর গরিষ্ঠ অংশ। কয়েক বছর আগে রিকশার ভাড়া নির্ধারণ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল আগের বাম পুরবোর্ড। বর্তমান তৃণমূলের পুরবোর্ড রিকশা ভাড়া নির্ধারণের কোনও উদ্যোগ এখনও পর্যন্ত নেয় নি। ফলে, অরণ্যশহরে রিকশাগুলি যে যেমন পারে ভাড়া নেয় বলে অভিযোগ আরোহীদের। শহরের মোট ২২০ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে মাত্র ৫৩ কিলোমিটার রাস্তা পিচের। মেন রোড-সহ গুরুত্বপূর্ণ মোট ১৭ কিমি রাস্তার দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে পূর্ত দফতর। বাকি ২০৩ কিমি রাস্তার মালিক পুরসভা। ঘুরপথে বাস ও লরি চলাচলের ফলে জেলখানা হয়ে কদমকানন যাওয়ার পূর্ত দফতরের পিচ রাস্তাটির বেহাল অবস্থা। প্রয়াত চিকিৎসক ললিত পাহাড়ির বাড়ি থেকে অরণ্যসুন্দরী অতিথিশালা পর্যন্ত পিচ রাস্তাটির অবস্থাও খুবই খারাপ।
ঝাড়গ্রাম পুর-নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক তপন চক্রবর্তীর বক্তব্য, “রিকশা ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আগের পুরবোর্ড ব্যর্থ হয়েছিল। নতুন পুরবোর্ডও এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। পাঁচশো মিটার দূরত্বে রিকশা ভাড়া হাঁকে ৪০-৫০টাকা। এমন ভাড়া কোথাও আছে বলে জানা নেই। এমন ভাবে উড়ালপুল তৈরি হচ্ছে, তাতে সুরাহার চেয়ে সমস্যা বেশি হবে।” যদিও পুরসভার পূর্ত বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কাউন্সিলর তপন সিংহের দাবি, “শহরের পরিবহণ সমস্যা মেটানোর জন্য ৪৯টি নতুন পিচ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিছু গলির রাস্তা ঢালাইয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ডের সংস্কারের জন্যও অর্থ বরাদ্দ হয়েছে।” পুরপ্রধান দুর্গেশ মল্লদেবের আশ্বাস, “পরিবহণ সমস্যা মেটাতে কার্যকরী পদক্ষেপ করা হবে। শহরে অভিন্ন রিকশা ভাড়া চালু করার পাশাপাশি, অটো সার্ভিস চালুর চিন্তাও করা হচ্ছে।”