Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মাল্টিপ্লেক্স নেই, মান্ধাতার হলে অনীহা তমলুকের

সার্কাসের তাবুর মতো চট দিয়ে ঘেরা হল আর মাটিতে খড় পেতে তৈরি আসনে বসে দর্শকরা বুঁদ হয়ে দেখছেন ‘রাজা চন্দ্রগুপ্ত’। তিন ঘণ্টার ছবির শো দেখতে জমাটি ভিড় দর্শকদের। না, কোনও কল্পকথা নয়, তমলুক শহরে বায়োস্কোপ দেখার শুরুটা হয়েছিল এভাবেই। শহরের রাজ ময়দানে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে মাধবকিঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, “সেটা ১৯৪০ সাল। তখন শহর-গ্রামের মানুষের বিনোদন বলতে ছিল যাত্রাপালা, আর সবে আসা এই বায়োস্কোপ দেখা। প্রতি বছর শীতকালে তমলুক রাজ ময়দানে বসত সিনেমা দেখার আসর।

বন্ধ চলন্তিকা সিনেমা হল।

বন্ধ চলন্তিকা সিনেমা হল।

আনন্দ মণ্ডল
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:৪০
Share: Save:

সার্কাসের তাবুর মতো চট দিয়ে ঘেরা হল আর মাটিতে খড় পেতে তৈরি আসনে বসে দর্শকরা বুঁদ হয়ে দেখছেন ‘রাজা চন্দ্রগুপ্ত’। তিন ঘণ্টার ছবির শো দেখতে জমাটি ভিড় দর্শকদের।

না, কোনও কল্পকথা নয়, তমলুক শহরে বায়োস্কোপ দেখার শুরুটা হয়েছিল এভাবেই। শহরের রাজ ময়দানে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে মাধবকিঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, “সেটা ১৯৪০ সাল। তখন শহর-গ্রামের মানুষের বিনোদন বলতে ছিল যাত্রাপালা, আর সবে আসা এই বায়োস্কোপ দেখা। প্রতি বছর শীতকালে তমলুক রাজ ময়দানে বসত সিনেমা দেখার আসর। সুকুমার গিরি, বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় আর ময়না রাজপরিবারের এক কর্তা মিলে তৈরি ‘গিরি টকিজ’ নামে একটি সংস্থা শীতের সময় এই সিনেমা দেখার আসর বসাত। পৌষ সংক্রান্তিতে তমলুক শহরে বারুণী মেলার দিনে সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলত একের পর এক শো।” তবে এখন তমলুকে হলমুখী দর্শকের সংখ্যা কমেছে। শহরের সিনেমা হলগুলিতে আধুনিক সুবিধা না থাকায় মুখ ফেরাচ্ছে তরুণ প্রজন্মও।

শহরের প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, ১৯৪৩ সাল নাগাদ তমলুক শহরের ব্রহ্মা বারোয়ারি হলে শুরু হয়েছিল ‘চলন্তিকা বাণীচিত্র’ সিনেমা হল। সেই হলই ১৯৪৬ সালের ১ এপ্রিল তমলুক শহরের পার্বতীপুরের দোতলা বাড়িতে স্থায়ীভাবে শুরু হল ‘চলন্তিকা’ নাম নিয়ে। তার কয়েক বছর পরেই টাউন শঙ্করআড়া এলাকায় শুরু হল ‘রূপশ্রী’ সিনেমা। প্রথমে ‘নারায়ণী’ নামে শুরু হলেও পরবর্তীকালে ‘রূপশ্রী’ নামে চালু হয় এই সিনেমা হল। সেই সময় দর্শক টানার জন্য এই দুই সিনেমা হলের মধ্যে লড়াই চলত। পরে আশির দশকে শহরের মানিকতলায় শুরু হয় ‘শ্রী দুর্গা’ সিনেমা হল।

তবে সময়ের সঙ্গে ভিড় কমেছে সিনেমা হলে। একসময়ের তমলুকের প্রথম সারির সিনেমা হল চলন্তিকা এখন বন্ধ। শ্রীদুর্গা হলও চলছে টিমটিম করে। রূপশ্রীর আসন সংখ্যা ১১০০ থেকে কমে চারসোর কোটায় এসে ঠেকেছে। শহরের বাসিন্দাদের মতে, তমলুক শহরের সিনেমা হলগুলি দীর্ঘদিনের পুরনো। তুলনায় শহর লাগোয়া রাধামণির ‘শ্যামাশ্রী’, ১৫ কিলোমিটার দূরের মেচেদার ‘মানসী’ ও মহিষাদলের ‘গীতা’ হলে ব্যবসা ভালই হয়।

ষাটের দশকে তমলুক রাজবাড়িতে তপন সিংহের পরিচালনায় ‘কেদার রাজা’ ছায়াছবির শু্যটিং হয়েছিল। ছবিতে পাহাড়ি সান্যাল, লিলি চক্রবর্তীদের সঙ্গে ছিলেন শমিত ভঞ্জ। ‘রূপশ্রী’ সিনেমা হলের হেড অপারেটর বর্ষীয়ান রবীন্দ্রনাথ পণ্ডা বলেন, “ছবির শুভমুক্তির দিনেই আমাদের হলে প্রচুর দর্শকের ভিড় জমেছিল।” শমিত ভঞ্জ ছাড়াও স্বাদেশিকতার কাহিনী অবলম্বনে তৈরি ‘সীমানা’ ছবির নায়ক ছিলেন তমলুকের আর এক অভিনেতা সুব্রত ভট্টাচার্য। সিনেমার স্মৃতি হাতড়ে রবীন্দ্রনাথবাবুর আক্ষেপ, “প্রযুক্তির উন্নতি হলেও লোকেরা সিনেমা দেখতে আসে না বললেই চলে। এখন অধিকাংশ ছবি এক-দু’সপ্তাহের বেশি দিন চলে না।”

একসময় ‘তমলুক সিনে সোসাইটি’, ‘তমলুক ফিল্ম সোসাইটি’র মতো সংস্থা গড়ে চলচ্চিত্র উৎসব করা হত। সেসব এখন অতীত। শুধু সিনেমা দেখার জন্য নয়, একসময় নাটক ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর বসত চলন্তিকা ও রূপশ্রী সিনেমা হলে। এ টি কানন, মালবিকা কানন, আল্লারাখা রহমান, কণ্ঠে মহারাজ, আলি হোসেন, কেরামাতুল্লা, মণিলাল নাগ, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো একাকালের প্রথিতযশা কণ্ঠ ও যন্ত্র শিল্পীরা তমলুকে অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন। মহম্মদ রফি, আশা ভোঁসলে, রাহুল দেববর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, আরতি মুখোপাধ্যায়, ঊষা উত্থুপের মতো বিখ্যাত শিল্পীরা অনুষ্ঠান করতে শহরে এসেছেন।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে বিনোদনের ধারা। এখন হলে গিয়ে সিনেমা দেখার থেকে ঘরে বসে সিডি, ডিভিডিতে সিনেমা দেখতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ নবীন প্রজন্ম। সিনেমা দেখার পাশাপাশি একই ছাদের তলায় খাওয়া-দাওয়া, শপিংয়ের সুবিধাযুক্ত মাল্টিপ্লেক্সের প্রতিও আকর্ষণ বাড়ছে। তবে তমলুক পূর্ব মেদিনীপুরের সদর শহর হলেও এখানে কোনও মাল্টিপ্লেক্স নেই। শহরে আধুনিক মানের প্রেক্ষাগৃহও না থাকায় হলে গিয়ে সিনেমা দেখার প্রতি তরুণ প্রজন্মের ঝোঁক কমছে। কলেজ পড়ুয়া অনিন্দিতা মাইতি, তমাল চক্রবর্তী, দীপাঞ্জন দাস বলেন, “কলকাতার সঙ্গে তমলুকের তুলনা করছি না। কিন্তু আমাদের শহরে না আছে ভাল সিনেমা হল, না মাল্টিপ্লেক্স। আমরা যাব কোথায়।”

একই অবস্থা তমলুক শহরের নাট্যচর্চার ক্ষেত্রেও। তমলুক শহরের মধ্যে একাধিক ছোট-বড় হল থাকলেও তা নাটকের উপযোগী নয় বলে অভিযোগ। শহরের নাট্য শিল্পীদের মতে, পুরসভার অফিস ভবনের উপরে ‘মহেন্দ্র স্মৃতি সদন’ বা সদ্য চালু হওয়া ‘সুবর্ণ জয়ন্তী ভবন’, কোনও হলেই নাটকের জন্য আধুনিক ব্যবস্থাপনা নেই। রাজ্যের অন্যতম প্রাচীন শহর তমলুক জেলার সদর শহরের মর্যাদা পাওয়ার পর বারো বছর কেটে গিয়েছে। কিন্তু শহরে আধুনিকতার ছোঁয়া কবে লাগবে, প্রশ্ন সেটাই।

ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

multiplex ananda mondal medinipur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE