Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

রাস্তার কাজে জটিলতা, বরাদ্দ খরচে হিমসিম

এ যেন উলটপুরাণ! বরাদ্দ আদায়ের জন্য এতদিন লড়াই করতে হত। এখন বরাদ্দের পর বরাদ্দ জুটছে। আর তা বাস্তবায়িত করতে হিমসিম খাচ্ছে প্রশাসন। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় এমনই ছবি উঠে এসেছে পশ্চিম মেদিনীপুরে। গ্রামীণ এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে ২০০০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা প্রকল্প চালু করেছিল।

যন্ত্রণার যাত্রা। ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে শালবনির মেটাল যাওয়ার রাস্তা এখনও পাকা হয়নি। স্থানীয় গ্রামগুলির সঙ্গে জাতীয় সড়কের সংযোগকারী প্রধান এই রাস্তা মাটির হওয়ায় বর্ষাকালে কাদায় ভরে যায়। কর্দমাক্ত এই পথ দিয়েই চলছে যাতায়াত। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

যন্ত্রণার যাত্রা। ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে শালবনির মেটাল যাওয়ার রাস্তা এখনও পাকা হয়নি। স্থানীয় গ্রামগুলির সঙ্গে জাতীয় সড়কের সংযোগকারী প্রধান এই রাস্তা মাটির হওয়ায় বর্ষাকালে কাদায় ভরে যায়। কর্দমাক্ত এই পথ দিয়েই চলছে যাতায়াত। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৪ ০১:৫১
Share: Save:

এ যেন উলটপুরাণ!

বরাদ্দ আদায়ের জন্য এতদিন লড়াই করতে হত। এখন বরাদ্দের পর বরাদ্দ জুটছে। আর তা বাস্তবায়িত করতে হিমসিম খাচ্ছে প্রশাসন। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় এমনই ছবি উঠে এসেছে পশ্চিম মেদিনীপুরে।

গ্রামীণ এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে ২০০০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা প্রকল্প চালু করেছিল। ২০০০-২০১১ পর্যন্ত অর্থাৎ ১১ বছরে এই প্রকল্পে জেলা রাস্তার তৈরির বরাত পেয়েছিল মাত্র ১৭৬৪ কিলোমিটার। ফলে জেলার বিভিন্ন ব্লক বঞ্চনার অভিযোগে সোচ্চার হত। কারণ, সব ব্লককে চাহিদা অনুযায়ী রাস্তার বরাত দেওয়া সম্ভব ছিল না। মাওবাদী সমস্যার জন্য হঠাৎ ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে এই প্রকল্পে এক লাফে জেলাকে ১৫১০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। দু’বছর গড়িয়ে গেলেও সবে ওই বরাতের মাত্র এক তৃতীয়াংশ কাজ শেষ হয়েছে। তার উপরে ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে ফের ৯৩০ কিলোমিটার রাস্তার বরাদ্দ এসে হাজির। এই পরিস্থিতিতে কিভাবে রাস্তার কাজ শেষ করা হবে তা নিয়ে মাথায় হাত প্রশাসনিক কর্তাদের। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ শৈবাল গিরি বলেন, “ঠিকাদারদের সব ধরনের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। তবু কেন তাঁরা কাজ নিতে রাজি হচ্ছেন না বুঝতে পারছি না।”

এমন চললে যে জেলার উন্নয়ন থমকে যাবে তা কারও অজানা নয়। তাই রাজ্য থেকে বারেবারেই দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এক একটি রাস্তার জন্য ৩-৪ বার দরপত্র আহ্বানের পরেও ঠিকাদার মিলছে না। সমস্যা দেখে এ বার ৯ শতাংশ বেশি হারে রাস্তা তৈরির বরাত দেওয়া হল কেন্দ্রীয় ঠিকাদারি সংস্থা এনবিসিসি এবং এনপিসিসি-কে। যদিও এখনও তাঁরা কাজ শুরুই করেনি। সবে এনবিসিসি-র আধিকারিকেরা জেলায় এসে হাজির হয়েছেন। এনপিসিসি এখনও আসেনি। তাঁরা যাতে দ্রুত আসেন সে জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) পাপিয়া ঘোষ রায়চৌধুরী বলেন, “এ বার যাতে দ্রুত গতিতে রাস্তার কাজ শেষ করা যায় সে জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ করা হচ্ছে।”

কেন ঠিকাদারের কাজ নিতে রাজি হচ্ছেন না? ঠিকাদারেরা জানিয়েছেন, কাজের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা তিনটি। প্রথমত, এই কাজের জন্য কারও জমি বা বাড়ি গেলে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না। ফলে অনেক কষ্টে কেউ কিছুটা জমি ছাড়লেও বাকি জমি থেকে মাটি তুলতে দিতে চান না। বাইরের থেকে মাটি এনে কাজ করতে গেলে খরচ উঠবে না। একগুচ্ছ টাকা খরচ করে মাল ফেলে রাখতে হয়। বেশিদিন পড়ে থাকলে মালপত্র চুরিও যায়। ক্ষতির অঙ্ক বাড়তে থাকে। আর একটি বড় সমস্যা হল বালি।

এ ক্ষেত্রে আর একটি বড় সমস্যা হল, এই প্রকল্পে তৈরি রাস্তার ৫ বছরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঠিকাদারের। কোনও রাস্তার কাজ প্রায় সম্পূর্ণ। কিন্তু কোথাও একটি বাড়ি ভাঙতে হবে, কেউ বা সামান্য জমি দিতে রাজি নন, তা নিয়ে থানা-পুলিশ-আদালত। জটিলতায় ১০০ মিটার রাস্তার কাজ শেষ করা গেল না। ফলে কাজ শেষের শংসাপত্র মিলবে না। ঝামেলা মেটাতে হয়তো তিন বছর সময় লাগল। সেই তিন বছর সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়া রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণ তো করতেই হবে, তারপর থেকে আরও ৫ বছর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। একদিকে কাজ শেষের শংসাপত্র না পাওয়ায় খরচ করা টাকা মিলবে না, উল্টে ঝামেলা। এক ঠিকাদারের কথায়, “বর্তমানে তৃণমূলের একাধিক গোষ্ঠী। বিবাদ মেটাতে একজনের কাছে গেলে অন্যজন বিবাদ বাড়ানোর চেষ্টা করেন। মাঝে পড়ে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব কেন। তাই কাজ নিতে চাইছি না। খুব চাপাচাপি করলে একটি-দু’টি কাজ নিচ্ছি।” ঠিকাদারেরা এ ভাবে চললে রাস্তা নির্মাণের ভবিষ্যৎ যে অথৈ জলেই পড়ে থাকবে। তাই এখন ঠিকাদারদের নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে প্রশাসন। পূর্ত কর্মাধ্যক্ষের আক্ষেপ, “আমরা ঠিকাদারদের সব ধরনের সাহায্য করবো বলেছি। রাস্তা তৈরির জন্য কারও বাড়ি ভাঙতে হলে তাঁকে ‘নিজ গৃহ নিজ ভূমি’ প্রকল্পে বা অন্য প্রকল্পে বাড়ি তৈরি করে দেব। যাতে কোনও সমস্যা না হয়। তবু ঠিকাদারদের রাজি করাতে পারছি না। তবে হাল ছাড়ছি না।”

তাই যেটুকু কাজ হয়েছে, তা হাল না ছেড়ে চাপাচাপির কারণেই। ২০০০-২০১১ সাল পর্যন্ত ১৭৬৫.৪৩ কিলোমিটার (২৬৩টি রাস্তা) রাস্তার মধ্যে ১০২১.৬৬ কিলোমিটার (১৫২টি রাস্তা) রাস্তা তৈরির কাজ শেষ করতে পেরেছে প্রশাসন। বাকি ৭৪৩.৭৭ কিলোমিটার (১১১টি রাস্তা) রাস্তা তৈরির কাজ এখনও চলছে! দীর্ঘদিনের পুরনো কাজগুলি শেষ করার আগেই ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে অভাবনীয় ভাবে আরও ১৫১০ কিলোমিটার রাস্তা (২৭৯টি রাস্তা) তৈরির অনুমোদন মিলে যায়। ওই রাস্তার মধ্যে এখনও পর্যন্ত মাত্র ৫৪৪.৯৪ কিলোমিটার (৮৯টি রাস্তা) রাস্তা তৈরি হয়েছে। বাকি রাস্তা ৯ শতাংশ বেশি অর্থে নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুই কেন্দ্রীয় সংস্থাকে। তারই সঙ্গে ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে আবারও আরও ৯৩০ কিলোমিটার রাস্তা (২২৯টি রাস্তা) নির্মাণের বরাত মিলেছে। তার মধ্যে সবেমাত্র ৬টি রাস্তার দরপত্র আহ্বানের কাজ শেষ হয়েছে।

এক প্রশাসনিক কর্তার কথায়, “আগেই পরিস্থিতি আঁচ করে যদি রাজ্য সরকার স্থানীয় ঠিকাদারদের সাহায্য করত, দলীয় নেতাদের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করত, তাহলে অনেক আগেই এই কাজ হয়ে যেত। তবে এ বার অন্য ঠিকাদারেরা সঠিক খরচে কাজ করতে রাজি হবেন না। ফলে জেলা অতিরিক্ত বরাদ্দ পেলেও কাজ হবে কিনা সংশয় থেকেই গেল।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE