নির্মাণ: ধুলাগড়িতে নতুন করে তৈরি হচ্ছে বাড়ি। ছবি: সুব্রত জানা।
বাড়িতে ভাঙচুর চলছে যথেচ্ছ। লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে আগুন। বাইরে বোমা পড়ছে বৃষ্টির মতো। শিশুকে জড়িয়ে ইষ্টনাম জপছেন পুরুষ-মহিলারা। এর মধ্যেই দুষ্কৃতীদেরই কয়েক জন এসে নিরাপদে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন তাঁদের!
তাণ্ডব চলছে দোকানে। লাঠি, রডের ঘায়ে ঝনঝন করে ভাঙছে কাচ, ওষুধের শিশি। কাউন্টারে বসে ঠকঠক করে কাঁপছেন দোকানের মালিক। এক ঝটকায় তাঁকে দোকানের বাইরে টেনে এনে পালাতে বললেন তাণ্ডবকারীদের একাংশই!
অশান্তির ঠিক ছ’মাস পরে ধুলাগড়ি-কাণ্ডের কথা এ ভাবেই ফিরে এল ব্যানার্জিপাড়ার জরি ব্যবসায়ী বিশ্বনাথ দেবনাথ ও ধুলাগড়ি বাজারের ওষুধের দোকানের মালিক আনারুল নস্করের মুখে। বিশ্বনাথবাবুর বাড়িতে প্রায় তিরিশ ঘর ভাড়াটে। ঘটনার দিন তছনছ হয়ে গিয়েছিল ঘরগুলি। বাড়ির গায়ে এখনও বোমার দাগ।
কিন্তু তাঁদের গায়ে আঁচড়টুকু লাগেনি। বিশ্বনাথবাবুর কথায়, ‘‘আমাদের বের করে শুধু বাড়ি ভাঙচুর করে চলে গেল দুষ্কৃতীরা। এখানকার সব বাড়িতে এমনটাই হয়েছে।’’ আনারুলও বলছেন, ‘‘আমাদের গায়ে কোনও চোট লাগেনি। সবাই সহী সালামৎ রয়েছি।’’
ধুলাগড়ি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা প্রচারে তাই অবাক এলাকার মানুষই। সাঁকরাইল পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ তপন পাল বলেন, ‘‘সব মিলিয়ে ২০৭টি বাড়ি-দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৫০টি বাড়ির ক্ষতি খুবই বেশি। কিন্তু এক জনেরও শরীর থেকে রক্ত ঝরেনি।’’ সাঁকরাইল থানার পুলিশ কর্তাদের বক্তব্য, ‘‘জখম শুধু জনা পাঁচেক পুলিশ। এলাকার বাসিন্দা কাউকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়নি। কোনও মহিলা হেনস্থার অভিযোগ দায়ের করেননি।’’ এই ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে পুলিশ এ পর্ষন্ত মোট ৬৩ জনকে গ্রেফতার করেছে। এদের মধ্যে ৫৭ জন এখনও জামিন পায়নি।
কিন্তু তা হলে সোশ্যাল মিডিয়া আর রাজ্য-রাজনীতির বিতর্কের কেন্দ্রে কেন উঠে এল ধুলাগড়ি? খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে কেন হাওড়ার প্রশাসনিক সভায় ধুলাগড়ি প্রসঙ্গ তুলে ধমক দিতে হল পুলিশ-প্রশাসন, এমনকী নিজের দলের বিধায়কদেরও?
এর উত্তর পেতে গেলে চলে যেতে হবে ঘটনার মূলে।
ধুলাগড়িতে অশান্তির সূত্রপাত গত বছর ১৩ ডিসেম্বর। ওই দিন দেওয়ানঘাটের একটি শোভাযাত্রায় ইটপাটকেল ছোড়া নিয়ে গোলমাল বাধে। গ্রেফতার করা হয় পাঁচ জনকে। এই ঘটনার পরে ভাঙচুর হয় সেখানকার কয়েকটি দোকান। এই ভাঙচুরের কথাই পল্লবিত হয়ে রটে যায় গোটা এলাকায়। এর জেরে পরদিন ধুলাগড়ি বাজার এবং ব্যানার্জিপাড়ায় তাণ্ডব চালায় কয়েকশো দুষ্কৃতী। এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয় শেখ আইনুল ও সাদ্দাম হোসেন নামে দুই তৃণমূলকর্মী। এর মধ্যে আইনুল ধুলাগড় পঞ্চায়েতের সদস্যও। সাঁকরাইলের বিধায়ক শীতল সর্দার ও পাঁচলার বিধায়ক গুলশন মল্লিকের অত্যন্ত কাছের এই দু’জনই গোলমালের মাথা বলে মনে করছে পুলিশ-প্রশাসন।
পুলিশের একাংশের বক্তব্য, গোলমালের পিছনে রয়েছে জমি কেনাবেচা ঘিরে এলাকা দখলের অঙ্ক। বিরুদ্ধ গোষ্ঠীকে এলাকা ছাড়া করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল আইনুলের। ঘটনার আগের রাতে বাইরে থেকে সে বহু দুষ্কৃতীকে ডেকে আনে। নিজের ক্ষমতা বোঝাতে বাড়ি-দোকানে ভাঙচুর চালায়। এর পাল্টা তাণ্ডব চালায় জমি ছাড়তে নারাজ অন্য পক্ষও।
গুলশন অবশ্য তার সঙ্গে আইনুল ও সাদ্দামের যোগাযোগের কথা মানতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সাদ্দামকে চিনি। তবে ওকে আমি কোনও মদত দিইনি। আর আইনুল তো শীতল সর্দারের লোক।’’
শীতল সর্দার সে কথা মেনে নিয়েও বলছেন, ‘‘আইনুল নির্দোষ। ওকে ফাঁসানো হয়েছে।’’
কিন্তু এই ঘটনার ফলে এলাকায় রাজনৈতিক জমি অনেকটাই হারিয়েছে শাসক দল। শক্তি বাড়াচ্ছে বিজেপি। তৃণমূলের শীর্ষনেতারা এখন তাই আইনুল ও তার দলবলকে প্রশ্রয় দিতে রাজি নন। তৃণমূল সূত্রের খবর, হাওড়ার প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী শীতল সর্দারকে কথাই বলতে দেননি। সাঁকরাইল বিধানসভা এলাকার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণও তাঁর হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy