Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

দল সাসপেন্ড করতেই সুর নরম দীপকের

মাস দুয়েক আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল চিত্রনাট্য। দলে তাঁর ঘনিষ্ঠদের দাবি, প্রায় সেই ছকমাফিকই ডায়মন্ড হারবারের ফকিরচাঁদ কলেজে গোলমালের ঘটনায় গ্রেফতারের পরে দল থেকে সাসপেন্ড হলেন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক দীপক হালদার।

বিধানসভা থেকে বেরিয়ে আসছেন দীপক হালদার। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র।

বিধানসভা থেকে বেরিয়ে আসছেন দীপক হালদার। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র।

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৪
Share: Save:

মাস দুয়েক আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল চিত্রনাট্য। দলে তাঁর ঘনিষ্ঠদের দাবি, প্রায় সেই ছকমাফিকই ডায়মন্ড হারবারের ফকিরচাঁদ কলেজে গোলমালের ঘটনায় গ্রেফতারের পরে দল থেকে সাসপেন্ড হলেন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক দীপক হালদার। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বুধবার বলেন, ‘‘দল-বিরোধী কাজের অভিযোগে বিধায়ককে দল থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সাসপেনশন বহাল থাকবে।’’ শাসক দলে দীপকবাবু এই মুহূর্তে চতুর্থ বিধায়ক, যাঁর উপরে সাসপেনশনের খাঁড়া নামল।

‘পরিবর্তনে’র বছরে বিধায়ক হওয়ার পরে সিপিএমের হাত থেকে ডায়মন্ড হারবার বন্দরে শ্রমিক সংগঠনের দখল নেন দীপক। বিধায়কের রাজনৈতিক জীবনে কালো ছায়া নেমে আসার পিছনে ওই শ্রমিক সংগঠনই বড় ভূমিকা নিয়েছে মনে করছেন জেলা তৃণমূলের একাংশ। দলের অন্দরের খবর, ডায়মন্ড হারবার বন্দর-এলাকা দখল নেওয়ার পর থেকেই বিধায়কের বিরোধী গোষ্ঠী দলে ভারী হতে শুরু করে। তখন ডায়মন্ড হারবারের পুরপ্রধান পান্নালাল হালদারের গোষ্ঠীর সঙ্গে নানা বিষয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়তে থাকেন দীপক। কিন্তু দক্ষ সংগঠক দীপকের সঙ্গে লড়াইয়ে হালে পানি পাচ্ছিল না পান্নালাল গোষ্ঠী। গত লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই দলীয় গোষ্ঠী রাজনীতিতে সমীকরণ বদল শুরু হয়। ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পরে পান্নালাল গোষ্ঠী দীপকের বিরুদ্ধে একের পরে এক অভিযোগ জানাতে শুরু করে। বন্দরের শ্রমিক সংগঠনের ‘একচ্ছত্র’ দখলদারির বিষয়টিও সাংসদকে জানানো হয়।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, ডায়মন্ড হারবার বন্দরে জাহাজ থেকে মাল খালাসের জন্য দিনে শ’পাঁচেক শ্রমিক সরবরাহ করা হয়। মজুরির একটি অংশ শ্রমিক সংগঠনের তহবিলে জমা পড়ে। সব মিলিয়ে সে বাবদ শ্রমিক সংগঠনের আয় বছরে কোটির অঙ্ক ছাড়িয়ে যায়। লোকসভা নির্বাচনের পরে দীপককে কোণঠাসা করে ওই বন্দরের দেখভালের দায়িত্ব সাংসদ-ঘনিষ্ঠ সোনারপুর এলাকার বাসিন্দা তৃণমূল নেতাকে দেওয়া হয়। দীপক-ঘনিষ্ঠদের অভিযোগ, বন্দরের দখল কেড়ে নেওয়ার পরেই বিধায়ককে বিপাকে ফেলার চিত্রনাট্য তৈরি করা হয়। মাসদুয়েক আগে সরিষায় দলীয় কার্যালয়ে এক বৈঠকে ডায়মন্ড হারবার ১ ও ২ পঞ্চায়েত সমিতির কয়েক জন এবং ১৬টি পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্যেরা দীপকের বিরুদ্ধে নানা বিষয়ে লিখিত অভিযোগ জমা দেন। ওই সব অভিযোগ তৃণমূল ভবনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জেলা তৃণমূলের এক নেতা ঘনিষ্ঠ মহলে মানছেন, ‘‘দীপকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রীর কানেও দেওয়া হয়েছিল। তার পরেই ছক তৈরি ছিল।’’ কলেজে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়া মাত্রই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে দীপক গ্রেফতার হন।

দলের অন্দরে এক কালে তৎকালীন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এবং অধুনা এক তরুণ সাংসদের ঘনিষ্ঠ দীপকবাবুর বিরুদ্ধে বন্দর ছাড়াও আরও নানা প্রশ্নে বিরূপ রিপোর্ট জমা হচ্ছিল তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে। বিধায়কের স্ত্রী-ই স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির প্রধান। এলাকার যে কোনও বিষয়ে তাঁদের জড়িয়ে পড়া এবং স্থানীয় বর্ষীয়ান নেতাদের কোনও আমল না দেওয়ার অভিযোগ শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে অসহ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। দলের একাংশের বক্তব্য, সেই জন্যই অপেক্ষা ছিল দীপকবাবুর তেমন বড় কোনও ভুলে প্রকাশ্যে জড়িয়ে পড়ার। কলেজ-কাণ্ড যে সুযোগ এনে দিয়েছিল! তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, শীর্ষ নেতাদের একাংশের নির্দেশেই জামিনযোগ্য ধারায় অভিযোগ দায়ের হয়, যাতে সহজেই বিধায়ক জামিন পান। কিন্তু দলে কোনও সহানুভূতি যাতে দীপক না পান, তা নিশ্চিত করার জন্য কলেজে মারধরের ঘটনায় জড়িয়ে গ্রেফতার হওয়ার ‘দাগ’টিও রেখে দেওয়া হয়। তাঁর অনুগামীরা মনে করছেন, এলাকায় উন্নয়নমূলক কাজ এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার দৌলতে আগামী বিধানসভা ভোটে টিকিট পাওয়ার যে দাবি দীপক জানাতে পারতেন, তা-ও নষ্ট হয়ে গেল সাসপেনশনের পরে!

শীর্ষ নেতৃত্বের মনোভাব দেখে দীপকবাবুও বুঝে নিয়েছেন, তাঁর রাস্তা কঠিন হয়ে গিয়েছে! গত দু’দিনের ‘চক্রান্তে’র সুর নরম করে বিধানসভার সামনে দাঁড়িয়ে বিধায়ক বলেছেন, ‘‘আমি দলের অনুগত সৈনিক। মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ নই। আমার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর গায়ে কালি লাগুক, চাই না। এই সিদ্ধান্ত (সাসপেনশন) মাথা পেতে নিলাম।’’ দল এবং নেত্রীর অনুগত হয়েই তিনি থাকতে চান জানিয়ে দীপকবাবুর স্বীকারোক্তি, ‘‘সে দিন বারবার ফোন পাচ্ছিলাম, কলেজে পুলিশের সামনেই ছেলেদের মারধর করা হচ্ছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে আইসি-র দিকে আঙুল উঁচিয়ে কথা বলা আমার উচিত হয়নি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE