Advertisement
১৯ মে ২০২৪

দুবাইয়ে টাকা পাচারের ছক, চক্রী মার্টিনই

সন্দেহের কেন্দ্রে তিনিই ছিলেন। কলকাতায় নগদ প্রায় ৪৫ কোটি টাকা উদ্ধারের পরে গোয়েন্দারা শুক্রবার নিশ্চিত হয়েছেন, ওই কুবেরের খাজানার নেপথ্যে আছেন চেন্নাইয়ের লটারি-মাফিয়া সান্তিয়াগো মার্টিনই। প্রাথমিক তদন্তে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতর জানতে পেরেছে, ওই টাকার একটি বড় অংশ হাওয়ালার মাধ্যমে দুবাইয়ে পাঠানোর কথা ছিল।

শিশু কোলে সান্তিয়াগো মার্টিন। রয়েছেন তাঁর অনুচর নাগরাজনও (ডান দিকে)। ছবি পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।

শিশু কোলে সান্তিয়াগো মার্টিন। রয়েছেন তাঁর অনুচর নাগরাজনও (ডান দিকে)। ছবি পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৪
Share: Save:

সন্দেহের কেন্দ্রে তিনিই ছিলেন। কলকাতায় নগদ প্রায় ৪৫ কোটি টাকা উদ্ধারের পরে গোয়েন্দারা শুক্রবার নিশ্চিত হয়েছেন, ওই কুবেরের খাজানার নেপথ্যে আছেন চেন্নাইয়ের লটারি-মাফিয়া সান্তিয়াগো মার্টিনই। প্রাথমিক তদন্তে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতর জানতে পেরেছে, ওই টাকার একটি বড় অংশ হাওয়ালার মাধ্যমে দুবাইয়ে পাঠানোর কথা ছিল।

কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাদের সঙ্গে নিয়ে বৃহস্পতিবার মহানগরীর পাঁচটি জায়গা এবং শিলিগুড়ির একটি জায়গায় অভিযান চালিয়ে থেকে ওই টাকা বাজেয়াপ্ত করে আয়কর দফতর। তবে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-কেও এই ঘটনার তদন্তে নামতে বলা হয়েছে। ইডি ইতিমধ্যে ‘প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট’ (পিএমএলএ) বা টাকা পাচার রোধ আইনে মামলা রুজুও করেছে।

তদন্ত সংস্থা সূত্রের খবর, মার্টিনই যে গোটা ঘটনার মূল চক্রী, তার নিশ্চিত প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু এখনও তাঁকে গ্রেফতার করা যায়নি। তাঁকে খুঁজছে সিবিআই-ও। কলকাতায় জমানো টাকার একটি বড় অংশ হাওয়ালা মারফত দুবাইয়ে পাঠানোর তোড়জোড় চলছিল। ঠিক ছিল, ভারতের কোনও হাওয়ালা কারবারিকে ওই টাকা দেওয়া হবে। দুবাইয়ে সেই কারবারির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হবে সমান অঙ্কের অর্থ। তদন্তকারীরা বলছেন, দুবাই, টাকা আর অন্ধকার জগতের কথা একসঙ্গে উঠলে প্রথমেই মাথায় আসে দাউদ ইব্রাহিমের নাম। তবে মার্টিনের লটারি-চক্রের এই টাকার সঙ্গে দাউদের কোনও যোগ আছে কি না, সেই বিষয়ে গোয়েন্দারা নিশ্চিত ভাবে কিছু বলতে পারেননি। তাঁদের বক্তব্য, এই ব্যাপারে দিশা দেখাতে পারেন চেন্নাইবাসী মার্টিনই। সেই জন্য তাঁকে জেরা করা দরকার। কিন্তু তিনি এখনও নাগালের বাইরে।

শুধু দুবাই নয়, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ আছে মার্টিনের। কলকাতায় পাওয়া বিপুল অঙ্কের টাকার একটি অংশ হাওয়ালার মাধ্যমে ওই সব দেশেও পাঠানোর কথা ছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে। সেই কাজের জন্য মার্টিন বছর দুয়েক আগে নিজের বিশ্বস্ত অনুচর নাগরাজনকে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন। দক্ষিণ কলকাতায় বসে খুব সন্তর্পণে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল নাগরাজন-বাহিনী। তারা নিজেদের অফিসের বাইরে সিসিটিভি-র ক্যামেরা বসিয়ে রেখেছিল। এমন ভাবে সেই ক্যামেরা বসানো হয়েছিল যে, গলির মুখে সন্দেহজনক কোনও লোক বা গাড়ি হাজির হলেই তার ছবি ফুটে উঠত অফিসে রাখা মনিটরিং পর্দায়। তেমন কিছু দেখতে পেলেই সতর্ক হয়ে যেত অফিসের লোকজন।

তামিলনাড়ুতে লটারি-মাফিয়ার তাজ মার্টিনেরই দখলে। কেরল, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, পঞ্জাব, মেঘালয়, অরুণাচলেও তাঁর জাল ছড়ানো। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, কলকাতায় এই টাকার পাহাড় কী ভাবে গড়লেন মার্টিন?

গোয়েন্দা সূত্রের খবর, সুদূর দাক্ষিণাত্য থেকে উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন রাজ্যে থাবা বসানোর সময় থেকেই বাংলায় নজর পড়েছিল মার্টিনের। কয়েক বছর আগে ‘বেস্ট অ্যান্ড কোং’ নামে সিকিমের একটি সংস্থা কিনে নেন তিনি। সংস্থাটি সিকিম লটারির টিকিট বিক্রি করে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য লটারির ক্ষেত্রেও টিকিট বিক্রির বরাত নিয়েছিলেন মার্টিন। এ ভাবে লটারির টিকিট বিক্রি করা বেআইনি নয়। কিন্তু ওই টিকিট বিক্রির নামে জালিয়াতিটা অবশ্যই আইনবিরুদ্ধ। আর জালিয়াতি ছাড়া মার্টিনের পক্ষে ওই টাকার পাহাড় বানানো সম্ভব ছিল না বলে তদন্তকারীদের অভিমত।

কী ভাবে চলত জালিয়াতি?

মূলত দু’টি পন্থার হদিস পেয়েছেন তদন্তকারীরা। তাঁরা জানাচ্ছেন: রাজ্য লটারিতে যত টিকিট বিক্রির জন্য বরাত দেওয়া হতো, তার চেয়ে অনেক বেশি টিকিট ছাপিয়ে নিতেন মার্টিনের লোকেরা। তার জন্য লটারির টিকিট ছাপানোর মেশিনও ছিল তাঁদের। পুরোটাই বেআইনি আর এই বাঁকা পথেই টাকা জমাচ্ছিল ওই চক্র। দোকানে যে-লটারির টিকিট পাঁচ টাকায় বিক্রি করা হয়, মার্টিনের লোকজন সেটি দোকানদারের কাছে বিক্রি করতেন চার টাকা ৩০ পয়সায়। এক গোয়েন্দা অফিসার বলেন, ‘‘বেআইনি ভাবে এক লক্ষ টিকিট ছাপিয়ে নিলে অতিরিক্ত চার লক্ষ ৩০ হাজার টাকা চলে আসে। তার কোনও ভাগ বা হিসেব সরকারকে দিতে হয় না।’’ মার্টিন এ ভাবেই বছরের পর বছর বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা তুলেছেন বলে অভিযোগ। ইডি তদন্তে নেমেছে সেই জন্যই। পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ হাতে নিয়েই মার্টিনের ডানহাত নাগরাজন এবং অন্যদের গ্রেফতারের ছক কষেছে তারা।

বেআইনি ভাবে টাকা রোজগারের জন্য আরও একটি রাস্তা নিয়েছিল মার্টিন-বাহিনী। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন: যে-দিন লটারি খেলা হওয়ার কথা, সে-দিনও বিভিন্ন সিরিজের অনেক টিকিট পড়ে থাকে দোকানে। কোন সিরিজের কত টিকিট বিক্রি হয়নি, আগে থেকে নম্বর-সহ তা রাজ্য সরকারকে জানিয়ে দেওয়ার কথা। যাতে খেলার সময় সেই সব সিরিজের নম্বর বাদ রাখা হয়। এটাই নিয়ম। কিন্তু মার্টিনের চক্র সেই অবিক্রীত টিকিট দোকান থেকে তুলে নিয়ে তার কথা বেমালুম চেপে যেত। সরকারকে জানাত না। লটারিতে সেই সব অবিক্রীত টিকিটের কোনওটায় পুরস্কার উঠলে তার টাকা চলে যেত মার্টিনের পকেটে। এ ভাবেও গত কয়েক বছর ধরে কোটি কোটি টাকা রোজগার করেন ওই মাফিয়া।

তদন্তকারীরা জানান, কলকাতায় বসে মার্টিনের হয়ে এই কাজ পরিচালনা করতেন নাগরাজন। বৃহস্পতিবার নাগরাজনের ডেরায় হানা দিয়ে তাঁর ও মার্টিনের একসঙ্গে তোলা কিছু ছবি বাজেয়াপ্ত করেছেন গোয়েন্দারা। তা ছাড়া তাঁর কম্পিউটার ঘেঁটে দক্ষিণ ভারতে মার্টিনের ব্যবসার হিসেবপত্র পাওয়া গিয়েছে। এখন শুধু জাল গোটানোর পালা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

abpnewsletters Money laundering Martin
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE