Advertisement
২৪ জানুয়ারি ২০২৫

রসের ফোঁটায় দখলদারি গোকুলপিঠে মোতিপাকের

ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা... আর মুখে মিষ্টি। না হলে উৎসবটাই যে আর মিঠে থাকে না।

মিষ্টি কেনার লাইন। কৃষ্ণনগরের একটি দোকানে।

মিষ্টি কেনার লাইন। কৃষ্ণনগরের একটি দোকানে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৪৪
Share: Save:

ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা... আর মুখে মিষ্টি। না হলে উৎসবটাই যে আর মিঠে থাকে না।

কিন্তু ঠেলে-গুঁতিয়ে মিষ্টির মুখ দেখতে পাওয়াই এক রকম ঝক্কি। দোকানের সামনে গিজগিজ করছে শুধু কালো মাথা। যত ক্ষণে সামনের সারিতে পৌঁছনো, তত ক্ষণে ঘড়ির কাঁটা এক চক্কর ঘুরে ফেলেছে। শেষে দু’হাতে মিষ্টির হাড়ি নিয়ে বেরোনো তো নয়, মুখুজ্জে মশায়ের মুখে যেন যুদ্ধজয়ের হাসি। তা কী নিলেন? জিজ্ঞেস করতেই সহাস্যে বললেন, ‘‘সরপুরিয়া-সরভাজা তো নিয়েইছি। সে সঙ্গে এ বার টু-ইন-ওয়ান রসগোল্লা নিলাম।’’

চাকদহ থেকে কৃষ্ণনগর, বহরমপুর থেকে কান্দি, মিষ্টির দোকানগুলোর কমবেশি এক চেহারা। আয়োজনেরও ত্রুটি রাখেননি মিস্টি ব্যবসায়ীরা। কৃষ্ণনগরের পাত্রবাজারে মিষ্টির দোকান উদয় মোদকের। বললেন, ‘‘এ বছর মিষ্টির মেনুতে একটু নতুন কিছু রাখার চেষ্টা করেছি। যেমন ধরুন, স্যান্ডউইচ সন্দেশ, চকলেট কিংবা কমলালেবুর ফ্লেভারে টু-ইন-ওয়ান রসগোল্লা। তা ছাড়া পদ্মফুল, সূর্যমুখী ফুলের আদলে মিস্টি বানিয়েছি।’’

শুধু তা-ই নয়, আপেল থেকে আম, লিচু, পেঁপে, গাজর, তালশাঁস, কমবেশি সব ফলই মিলবে মিষ্টির দোকানে। শুধু জিভে পড়তেই মুখে মাখামাখি ক্ষীর। মূলত ক্ষীর নইলে ছানার সঙ্গে ফলের রস মিশিয়েই এই কেরামতি, জানাচ্ছেন দোকানের কর্মীরা। কৃষ্ণনগরের আনন্দময়ীতলার মিষ্টি ব্যবসায়ী তাপস দাস আবার বললেন, “কেশরভোগ, গরম গরম গোলাপজামের চাহিদাও ব্যাপক।”

চাকদহ থেকে কৃষ্ণনগরে কাজে এসেছিলেন সাগর ভট্টাচার্য। বললেন, ‘‘টু-ইন-ওয়ান রসগোল্লাটা খেয়ে দেখলাম। সত্যিই দারুণ বানিয়েছে এরা।’’ কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা সুস্মিতা ভট্টাচার্যের আবার মনে ধরেছে ফল সন্দেশ।

মিষ্টির পাতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পছন্দ নয় অনেকেরই। তাঁদের জন্য হাজির রসকদম্ব, মিহিদানার বরফি, কাজু সন্দেশ, নলেন গুড়ের সন্দেশ থেকে জলভরা তালশাঁস। কোথাও ‘ভাইফোঁটা’ লেখা ক্ষীরের সন্দেশ তো কোথাও আবার প্যাকেট বন্দি ‘ড্রাই ফ্রুট’ বিকোচ্ছে দেদার।

বহরমপুরের প্রাণকেন্দ্র কাদাইয়ের এক মিষ্টির দোকানে মিহিদানার বরফি, কাজু সন্দেশ, দরবেশ, চকোলেট সন্দেশ, রসকদম্ব, ছানাবড়া, রাজভোগের মত সাত রকমের মিষ্টি মাটির থালায় সাজিয়ে ভাইদের বরণ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে বিশেষ উপহার। দাম পড়বে ৯০ টাকা। এ ছাড়াও কাজু-পেস্তা-কিসমিসের মতো আট রকমের শুকনো ফল দিয়ে প্যাকেট ও ডালা সাজিয়েছে কোনও কোনও মিষ্টি বিক্রেতা। প্যাকেট অনুযায়ী দাম পড়বে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা।

তবে বহরমপুরবাসীর দাবি, ভাইফোঁটায় সব চেয়ে ‘হিট’ নারকেল ফুলের রস দিয়ে তৈরি গুড়ের সন্দেশ। কাদাইয়ের মিষ্টি ব্যবসায়ী শৈলেন ঘোষের কথায়, ‘‘নাম দেওয়া হয়েছে নীরা সন্দেশ।’’

স্থানীয় মিষ্টি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, কল্যাণী বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে হুগলীর বলাগড়ে নারকেল ফুল থেকে রসের চাষ হচ্ছে। ওই রসের নাম দেওয়া হয়েছে নীরা। এখন ওই রস ফুটিয়ে গুড় তৈরির পরে সেই গুড় থেকে সন্দেশ তৈরি হচ্ছে। যা ব্লাড সুগারের রোগীরাও খেতে পারবেন বলে দাবি শৈলেনবাবুর। তিনি বলেন, ‘‘শীত পড়লেই নীরা বিক্রি করব। ওই রস নিয়মিত পান করা লিভারের পক্ষে ভাল, বলছেন গবেষকরা।’’

পাশাপাশি, প্রতি বছরের মতো এ বারও ব্যাপক চাহিদা সাবেক ছানাবড়ার। এক কিলো ছানার সঙ্গে দেড়শো গ্রাম আটা মিশিয়ে তাতে সামান্য বড় এলাচ ও চিনি মিশিয়ে লেচি তৈরি রসগোল্লার আকার দিলেই হল। তার পর ঘিয়ে ভাজার অপেক্ষা। রসগোল্লার গায়ে কালচে রঙ না আসা পর্যন্ত ভাজা চলতেই থাকে। তার পর হালকা চিনির রসে ডুবিয়ে রাখতেই চক্ষু ছানাবড়া।

ভাইফোঁটার জন্য তৈরি রকমারি মিষ্টি। কৃষ্ণনগরের আনন্দময়ীতলায়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

সেই সঙ্গে রয়েছে রসকদম্ব, ক্ষীরের আপেল, ভাইফোঁটা লেখা ক্ষীরের সন্দেশ, নলেন গুড়ের হরেক রকমের সন্দেশ, জলভরা তালশাঁস ছাড়াও মিহিদানা, ছানার পোলাও, সীতাভোগ, ছোলার ডালের বোঁদে, ঘিয়ে ভাজা পান্তুয়ার মতো আরও কত কী।

তবে পান্তুয়া বললেই মনে পড়ে রানাঘাট, জানাচ্ছেন আরতি ঘোষ। রানাঘাটেরই বাসিন্দা শিউলি বাউলি গর্ব করে বলেন, “আর যাই বলুন না কেন, রানাঘাট শহর মানেই পান্তুয়া। ভাইফোঁটায় যে মিষ্টিই দিই না কেন, পান্তুয়া না দিলে মন ভরে না।” হরিদাস পালের তৈরি পান্তুয়াতেই রানাঘাটের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে। তিনি আর নেই, কিন্তু এখনও মুখে মুখে ফেরে তাঁর নাম।

এক সময় তিনি নিজে একটা মিস্টির দোকানে কাজ করতেন। পরে রানাঘাট স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফর্মের বাইরে নিজের দোকান করেছিলেন। বছর ত্রিশ হল সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কচুরি, সন্দেশ, দরবেশ, শিঙ্গাড়ার সঙ্গে তৈরি পান্তুয়াও। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে রানাঘাট শহরের পূর্বপাড়ের বাসিন্দা কেষ্ট অধিকারীর আক্ষেপ, “আজও শহরের বিভিন্ন দোকানে পানতুয়া পাওয়ায় যায়। কিন্তু, হরিদাস পালের অভাবটা রয়েই গিয়েছে।” কেস্টবাবু বলেন, “কত নামি-দামি ব্যক্তিকে ওঁর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পান্তুয়া খেতে দেখেছি।” তিনি বলেন, “আমি নিজেই ভানু বন্দোপাধ্যায়, সন্ধ্যা রায়ের মতো অভিনেতা-অভিনেত্রীকে ওই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পান্তুয়া খেতে দেখেছি।”

বহরমপুরের মিষ্টি ব্যবসায়ী বিজয়গোপাল সাহা জানান, ভাইফোঁটা উপলক্ষে ‘স্পেশাল’ আনারস ও আমের দই তৈরি হচ্ছে তাঁর দোকানে। এখনও সে ভাবে শীত না পড়ায় প্রথমটা একটু দোনোমনা ছিল। কিন্তু শেষমেশ গোকুল পিঠেও থাকছে তাঁর মিষ্টির মেনুতে।

অতীতে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন জমিদার বাড়িতে ভাইফোঁটা উপলক্ষে মিষ্টি বানানোর চল ছিল। ভাইফোঁটার অনেক আগে থেকেই তার প্রস্তুতিও শুরু হয়ে যেত রাজবাড়ির অন্দরমহলে। সেজে উঠত রাজবাড়ি। যেমন কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়িতে ভাইফোঁটায় বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি বানানোর রেওয়াজ ছিল। সরভাজা, সরপুরিয়া, চমচম, ক্ষীরের নাড়ু, ক্ষীরের ছাঁচ, রসমালাই, মোহনপুরি, মোতিপাক, ছানাবড়া, চন্দ্রপুলি-সহ আরও নানা রকমের মিষ্টি বানানোর জন্য ১০-১২ জন ময়রা সারা দিন ধরে রাজবাড়িতেই পড়ে থাকতেন। কাশিমবাজার রাজবাড়ির পুত্রবধূ সুপ্রিয়া রায় বলেন, ‘‘সেই সময়ে ছাঁচে চন্দ্রপুলি তৈরি হতো না। দু’হাতে কলা পাতা নিয়ে নারকেল-ক্ষীর-মোয়া দিয়ে মণ্ড তৈরি করে পুলির আকার দেওয়া হত।’’

সে সব আর নেই। আনারসের দই আর গোকুল পিঠে দিয়েই তাই ক্রেতাদের মন পাওয়ার চেষ্টায় বিজয়বাবুরা।

তথ্য: সামসুদ্দিন বিশ্বাস, শুভাশিস সৈয়দ ও সৌমিত্র শিকদার

অন্য বিষয়গুলি:

motipak sweets demand
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy