(বাঁ দিকে) টি-শার্ট উড়িয়ে দুর্ঘটনার হাত থেকে ট্রেনকে রক্ষা করা মুরসালিম। থেমে যাওয়া কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। —ফাইল চিত্র।
লাল জামাটা খুলে যখন রেললাইনের মাঝখান দিয়ে ছুটছিলাম, তখন বিন্দুমাত্র ভয় লাগেনি আমার। শুধু চাইছিলাম, ট্রেনটা যাতে দাঁড়িয়ে যায়! পরে ট্রেনটা যখন সত্যি সত্যিই দাঁড়িয়ে পড়ল, ভীষণ ভয় লেগেছিল তখন। খালি মনে হচ্ছিল, ভুল কিছু করে ফেললাম না তো? রেলের লোকেরা এসে আমায় কিছু বলবে না তো? কিন্তু তার পর যা ঘটল, তা আমি কখনও কল্পনা করিনি। এত লোকের আদর-ভালবাসা পাব, স্বপ্নেও ভাবিনি!
রেললাইনের পাশে একটা ছোট পুকুর আছে। আমরা বন্ধুরা প্রায়ই ওখানে গিয়ে মাছ ধরি। শুক্রবারও গিয়েছিলাম। ওখানে যাওয়ার সময়েই লাইনের মাঝে ওই বড় গর্তটা চোখে পড়েছিল। লাইনের তলার মাটি সরে গিয়ে সুড়ঙ্গের মতো হয়ে গিয়েছিল জায়গাটা। তখন শুধু দেখেছিলাম মাত্র। কিছু বুঝতে পারিনি। মাথাতেও আসেনি। কিন্তু মাছ ধরার সময় যখন আচমকা ট্রেনের আওয়াজটা শুনতে পাই, তখন ওই গর্তটাই চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। ট্রেনটা দূর থেকে আসছে দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। তার পর আর দেরি করিনি। লাল জামাটা খুলে লাইনের পাশে গিয়ে মাথায় ঘোরাতে ঘোরাতে শুরু করি। কিন্তু ট্রেনটা খুব স্পিডে আসছিল। বুঝতে পারছিলাম না, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে জামাটা ঘোরালে ট্রেন আদৌ দাঁড়াবে কি না। এর পরেই ‘‘ট্রেন থামাও, ট্রেন থামাও’’ বলে চিৎকার করতে করতে লাইন ধরে ছুট দিই।
লাল জামাটা সামনে ধরে রেখে যখন রেললাইনের মাঝখান দিয়ে ছুটছিলাম, তখনও জানতাম না ট্রেনটা থামবে কি না। শুধু গায়ে যত জোর আছে, সব দিয়ে ছুটছিলাম। একটু পরেই দেখলাম, ট্রেনটা হর্ন দিয়ে আস্তে আস্তে থেমে যাচ্ছে। ট্রেনটাকে থামতে দেখে আমিও থেমে যাই। ধীরে ধীরে ট্রেনটা থেমে যেতেই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। ওই সময় কী মনে হচ্ছিল, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। একটু বাদে দেখি, ট্রেন থেকে কয়েক জন নেমে আমার দিকে হেঁটে হেঁটে আসছে। সঙ্গে পুলিশও ছিল। ওই সময় আমার ভয় লাগতে শুরু করে। খুব ভয় করছিল তখন। তাও আমি শান্ত থাকার চেষ্টা করছিলাম। অন্য কেউ হলে হয়তো ভয়েই ওখান থেকে ছুটে পালিয়ে যেত। কিন্তু আমার সেটা মনে হয়নি। রেলের লোকগুলো কাছে এসে জিজ্ঞেস করতেই ওদের সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ওই গর্তটা দেখিয়ে দিয়েছিলাম। ওরাও গর্তটা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তার পরেই ওরা এদিক-ওদিক ফোন করা শুরু করে। ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল যে, কত বড় বিপদ হতে পারত! তখনই বুঝেছিলাম, আমি কোনও ভুল করিনি!
কিছু ক্ষণ পরেই আরও কয়েক লোকজন বড় বড় সব যন্ত্রপাতি এনে লাইনটা ঠিক করা শুরু করে। তত ক্ষণে গোটা গ্রাম জেনে গিয়েছে এই ঘটনার কথা। সবাই ছুটে এসেছিল। রেলের লোকগুলো এসে খুব আদর করছিল আমায়। এক জন চকোলেটও দিয়েছিল। ওই সময় খুব আনন্দ পেয়েছিলাম! একটু একটু গর্বও হচ্ছিল। পরে যখন বাড়িতে আসি। মা-ও ভীষণ আদর করেছিল। খুব খুশি হয়েছিল মা। বাবা তো এখানে থাকে না। বাইরে থাকে। গুজরাতে। আমার মুখে সব শুনে রাতেই বাবাকে ফোন করেছিল মা। আমার কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিল।
পর দিন সকালে কত লোক যে এসেছিল আমাদের বাড়িতে। এর আগে কখনও এত লোক আসেনি। এই প্রথম বার এল। বড় বড় গাড়ি করে। আমার সঙ্গে কথা বলল ওরা। সকলেই জানতে চাইল, ঠিক কী হয়েছে। আমি কী করেছি। সব্বাইকেই বললাম। খবরের লোকেরাও এসেছিল। সবাই খুব প্রশংসা করছিল আমার সাহসের। গ্রামের লোকেরা তো ভীষণ খুশি। আমাদের পাশের বাড়ির এক কাকু বলছিল— আমার জন্যই নাকি এই কড়িয়ালি গ্রামের কথা সবাই জেনেছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy