প্রতিষ্ঠার দিন থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত একটানা ৪৮ বছর ধুলিয়ানের পুরপ্রধান ছিলেন শচীন্দ্রনাথ রায়। ৩৯ বছর একটানা ছিলেন মুরলীধর গুপ্ত। ৩৫ বছর ধরে একটানা কাউন্সিলার নির্বাচিত হয়েছেন তিনপত সিং বয়েদ। আবার জেলার মধ্যে প্রথম মহিলা পুরপ্রধান হিসেবে চেনবানু খাতুন নির্বাচিত হয়েছিলেন এই শহরে। পাশাপাশি এই ধুলিয়ান পুরসভাকে ঘিরেই আস্থা, অনাস্থার বিস্তর নাটকও দেখেছে জেলার মানুষ। গত ১৮ বছরে কম করেও ১৩ বার।
শুধু এলাকা বা ওয়ার্ড সংখ্যা নয় বেড়েছে জনসংখ্যাও। ১৯৭২ সালে যেখানে ধুলিয়ান শহরের লোকসংখ্যা ছিল ৩১৯০৫, ১৯৮৯-এ তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮৮২৫-এ। শহরের সঙ্গে নতুন এলাকা যুক্ত হওয়ায় ২০০১-এ জনসংখ্যা বেড়ে গিয়ে হয় ৭২৯০৬ জন। ২০১৪ সালে সেই জনসংখ্যা ১.০৫ লক্ষে পৌঁছেছে।
জনসংখ্যার এই বৃদ্ধি যেমন শহরের যন্ত্রণা বাড়িয়েছে, ঠিক তেমনই গঙ্গার সর্বগ্রাসী ভাঙনের কবলে পড়ে ১৯৩০, ১৯৫০ এবং ১৯৭০ সালে বিপন্ন হয়েছে শহরের অস্তিত্ব। প্রাচীন ধুলিয়ান শহর বহু আগেই তলিয়ে গিয়েছে গঙ্গায়। ক্রমশ পশ্চিমে পিছিয়ে আসতে আসতে ধুলিয়ানের জনবসতি মুখ থুবড়ে পড়েছে বার বার। একাধিকবার ধ্বংসের মুখে পড়ায় কৌলিন্যে অন্য শহরগুলির চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে অনেকটাই। ভাঙনের তীব্রতা এতটাই যে ১৯৯৫ সালের ধুলিয়ান শহর লাগোয়া যে রেলপথ ছিল গঙ্গা থেকে ৭.৫২ কিলোমিটার দূরে, এখন সেই গঙ্গা ও রেলপথের মধ্যে ব্যবধান কমে দাঁড়িয়েছে ২ কিলোমিটার। একাধিকবার বসতি বদলের এই ধাক্কায় আর্থ-সামাজিক পরিবেশটাই যেন নষ্ট হতে বসেছে। রাজ্যের অন্যান্য শহরগুলির চেয়ে ধুলিয়ানের চেহারাটা সর্বত্রই ভীষণ ভাবে অবিন্যস্ত এবং অপরিকল্পিত।
ধুলিয়ান পুরসভা গঠনের পর পুরসভার প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ৪০ দফা উপবিধি তৈরি করে জারি হয় নিষেধাজ্ঞা। উদ্দেশ্য, শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখা, নাগরিক নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য সুনিশ্চিত করা। সেই সব উপবিধি চালু রয়েছে আজও। তবে তা খাতাকলমে। তা মেনে চলার দায়িত্ববোধও যেন কারও নেই। তাই ধুলিয়ানের শহর জুড়ে আজও রয়েছে জবরদখলের যন্ত্রণা, নিকাশি সমস্যা ও পানীয় জলের হাহাকার।
৪৮ বছর আগে শহরে পুর ভবনের পাশেই তৈরি হয়েছিল একটি ভূগর্ভস্থ পানীয় জল প্রকল্প। দুটি পাম্প বসিয়ে ভূগর্ভ থেকে তোলা জল পাইপ লাইনের মাধ্যমে মাত্র ৬টি ওয়ার্ডে পৌঁছয় বড় জোর ২০ শতাংশ মানুষের কাছে। সেই জল প্রকল্পে বসানো হয়েছে আয়রন রিমুভ্যাল ফিলট্রেশন ব্যবস্থাও। কিন্তু শহরের বাকি ৮০ শতাংশ বাসিন্দার ভরসা নলকূপ। কিন্তু সেই জলে বিপজ্জনক মাত্রায় মিশে রয়েছে আর্সেনিক। বছর ১৫ আগে শহরের বিভিন্ন এলাকায় নলকূপের মাধ্যমে জলে আর্সেনিকের পরিমাণ মাপার জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্য নেয় পুরসভা। জলে আর্সেনিকের মাত্রা ধরা পড়ে .০৯ মিলিগ্রাম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে মানুষের শরীরে আর্সেনিকের সহন ক্ষমতা .০১ মিলিগ্রাম। ভারত সরকারের মতে .০৫ মিলিগ্রাম। এই অবস্থায় পানীয় জলের জন্য স্থানীয় ভাবে গজিয়ে ওঠা ‘মিনারেল ওয়াটার’ কিনে বাড়িতে পানীয় জলের অভাব মেটাতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। ২০ লিটারের জল ভর্তি জ্যারিকেন বিকোচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। স্থানীয় বাসিন্দা কল্যাণ গুপ্তের কথায়, “নলবাহিত জল বাড়িতে এলেও তা সরু সুতোর মতো পড়ে। আবার পাম্প খারাপ বা লোডশেডিং হলে সেটুকুও জোটে না। বছর ছয়েক আগে একটি নতুন জল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল ধুলিয়ানে। ২ বছরেই কাজ শেষ করে জল পাওয়ার আশ্বাস মিললেও আজও তা অনিশ্চিত।”
পানীয় জলের এই সঙ্কটের কথা স্বীকার করেছেন ধুলিয়ানের উপ পুরপ্রধান তৃণমূলের দিলীপ সরকার। তিনি বলেন, “২ কোটি টাকার একটি জল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। সেই কাজ শেষ হলে গঙ্গা থেকে সরাসরি ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের মূল জলাধারে জল আসবে। সেখানে দৈনিক দেড় মিলিয়ন টন লিটার জল পরিশোধন করা হবে। সেই পরিশোধিত জল যাবে কাঞ্চনতলা, কাহারপাড়া ও পুর ভবন সংলগ্ন ১ লক্ষ গ্যালনের তিনটি জলাধারে। সেগুলি থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে ২১টি ওয়ার্ডের সব জায়গায় জল পৌঁছবে। জন প্রতি বাসিন্দারা প্রতিদিন জল পাবেন ১৩৫ লিটার করে।” তিনি জানান, প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ কাজই প্রায় শেষ। পাইপ লাইনও বসে গিয়েছে বেশির ভাগ এলাকাতেই। জলাধারগুলির নির্মাণও সম্পূর্ণ। জমি নিয়ে বিরোধের জন্য সে কাজ আটকে আছে। জমি জট কাটিয়ে খুব শীঘ্রই শুরু হবে বলে আশা তাঁর।
কিন্তু নেতার ওই কথায় ভরসা রাখতে পারছেন না কেউই। তাই পরিশ্রুত পানীয় জল এখনও অলীক স্বপ্ন শতবর্ষ প্রাচীন ধুলিয়ানে।