Advertisement
০১ এপ্রিল ২০২৩

সালিশির শিকড় গেঁথে গ্রামবাংলার মাটিতে

ঘটনা ১: বেলডাঙায় ২২ বছরের এক বিধবা তরুণীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল গ্রামেরই এক যুবকের। ঘটনাটি জানাজানি হতেই গ্রামে বসে সালিশি সভা। সালিশিতে মাতব্বরেরা রায় দেন বয়স কম বলেই এসব হচ্ছে। ওই তরুণীর বয়স ৪০ বছর না হওয়া পর্যন্ত গ্রামের বাইরে থাকতে হবে। সেই নিদান মেনে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয় ওই তরুণীকে।

বিমান হাজরা
রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৪ ০১:১০
Share: Save:

ঘটনা ১: বেলডাঙায় ২২ বছরের এক বিধবা তরুণীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল গ্রামেরই এক যুবকের। ঘটনাটি জানাজানি হতেই গ্রামে বসে সালিশি সভা। সালিশিতে মাতব্বরেরা রায় দেন বয়স কম বলেই এসব হচ্ছে। ওই তরুণীর বয়স ৪০ বছর না হওয়া পর্যন্ত গ্রামের বাইরে থাকতে হবে। সেই নিদান মেনে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয় ওই তরুণীকে।

Advertisement

ঘটনা ২: শীতলপাড়া গ্রামের এক অবিবাহিতা তরুণী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। সালিশি সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে ভোরের আলো ফোটার আগেই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে ওই তরুণীকে। পরদিন সকালে দেখা যায় রেল লাইনের উপর পড়ে রয়েছে ওই তরুণীর ক্ষতবিক্ষত দেহ।

ঘটনা ৩: ভিন্ বর্ণে বিয়ে করার শাস্তি হিসাবে কালিতলা গ্রামে এক সালিশি সভায় ওই দম্পতিকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সেই জরিমানা না দিতে পারার শাস্তি হিসাবে গ্রামের নলকূপ ও পুকুরের জল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। নিরুপায় ওই নব দম্পতিকে শেষ পর্যন্ত গ্রাম ছাড়তে হয়।

মুর্শিদাবাদের সালিশি সভার এই তালিকায় এ বার উঠে এল সাগরদিঘির দিয়ার বালাগাছি গ্রামের নাম। কী হয়েছিল ওই গ্রামে? পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বিবাহ-বিচ্ছিন্না সাহিনা খাতুন (১৯) থাকতেন বাপের বাড়িতে। গ্রামেই প্রতিবেশী এবাদুলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। বছর পঁচিশের এবাদুল বিবাহিত। দুই মেয়ে আছে তাঁর। দু’জনকে নিয়ে কুৎসা রটলে শনিবার রাতে সালিশি সভা বসে গ্রামে। সেখানে সাহিনা বিয়ে করতে চাইলেও বেঁকে বসে এবাদুল ও তাঁর পরিবার। দীর্ঘ কথা কাটাকাটির পরে ওই সভায় ঠিক হয় এবাদুলকে ১১ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। সাহিনাকে দিতে হবে এক হাজার টাকা। দু’পক্ষের এক হাজার করে মোট ২ হাজার টাকা গ্রামের উন্নয়নের কাজে লাগানো হবে। বাকি ১০ হাজার টাকা পাবে সাহিনার পরিবার। দুই পরিবারের লোকজন সালিশির সেই রায় মেনে নিলেও সালিশি থেকে ফিরে কিন্তু মনমরা ছিলেন সাহিনা। রবিবার দুপুরে বাড়িতেই ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয় তাঁর। সাহিনার পরিবারের দাবি, সালিশি সভায় প্রেমিক বিয়েতে অস্বীকার করার পর টাকায় রফা করা হয়েছিল। যা মেনে নিতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছেন ওই তরুণী। সোমবার প্রেমিক এবাদুল শেখ-সহ সালিশিতে যুক্ত গ্রামের কয়েকজনের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ দায়ের করেন মেয়ের বাড়ির লোকজন। কিন্তু মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত পুলিশ ওই ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। জেলার পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “সালিশির নামে বিচার মানেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া। এটা কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা যাবে না। ওই মাতব্বরদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে। অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।”

Advertisement

মুর্শিদাবাদে সালিশি সভা নতুন কিছু নয়। সুতি, সাগরদিঘি, সামশেরগঞ্জ, বেলডাঙা, ডোমকলের মতো বহু এলাকায় সালিশির যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। কোনও ব্যক্তির বিচার ও শাস্তির উদ্দেশে আয়োজিত সালিশি সভা সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। গত এক দশকে এই বিষয়ে একাধিক রায়ও দিয়েছে শীর্ষ আদালত। তারপরেও যে এমন ধরনের সালিশি সভা চলছে সাগরদিঘির ঘটনাই তা প্রমাণ করে দিল।

কেন বন্ধ হচ্ছে না সালিশি সভা? সরকারি আইনজীবী অশোক সাহা বলছেন, “এখনও কিছু গ্রাম রয়েছে যেখান থেকে থানা কিংবা আদালত বহু দূরে। পাশাপাশি থানা-পুলিশে মানুষের কিছু ভীতি আছে। ভয় আছে খরচেরও। তাছাড়া চটজলদি বিচার পুলিশ কিংবা আদালতের কাছে মেলে না বলে আইনি বৈধতা না থাকলেও এই ধরণের সালিশি সভা এখনও চলছে। তাছাড়া বহু গ্রামে সালিশির শিকড় অনেকে গভীরে চলে গিয়েছে। মাতব্বরদের কথা-ই সেখানে শেষ কথা। তাই মানুষকে এই বিষয়ে সচেতন না করলে এর প্রভাব কিন্তু থেকেই যাবে।”

জঙ্গিপুর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক কাশীনাথ ভকত বলেন, “গ্রাম্য কোনও সমস্যা গ্রামের মানুষ একসঙ্গে বসে সমাধান করতেই পারেন। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু গ্রামেরই কিছু মানুষ বিচারকের ভূমিকা নিয়ে কাউকে শাস্তি দেবেন, জরিমানা আদায় করবেন এমনটা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।”

বালাগাছিতে সালিশি সভার ওই মাতব্বররা অবশ্য ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, গ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এমন ধরনের সালিশি সভা হয়েই থাকে। তা ছাড়া সভায় কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম সব পক্ষেরই নেতা ছিলেন। সকলের সায় নিয়েই রায় দেওয়া হয়েছিল। দু’ পক্ষ তা মেনেও নিয়েছিল। এ নিয়ে এত শোরগোলের কী আছে?

বালাগাছির আত্মঘাতী ওই তরুণীর বাবা আলতাব শেখ অবশ্য বলছেন, “ভেবেছিলাম গ্রামের সালিশিতে বসেই সব মিটমাট করে নিলে আর কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু বিয়ের বদলে টাকাপয়সা নিতে রাজি হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা যে সাহিনা মানতে না পেরে নিজেকে শেষ করে দেবে, এটা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। তাহলে সালিশি সভাতে কিছুতেই যেতাম না।”

আলতাব ভুলটা বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু সাহিনাকে বাঁচানো যায়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.