মোটামুটি অর্ধেক আসনে ঘুঁটি সাজানো হয়ে গিয়েছে। সতেরোর মধ্যে নয়।
বাকি আটটির মধ্যে দু’টি আসন— রানাঘাট উত্তর-পূর্ব এবং কৃষ্ণনগর উত্তরে তারা প্রার্থী দিচ্ছে বলে ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস। রইল বাকি ছয়।
এবং এই আধ ডজন আসন নিয়েই এখন তুমুল দড়ি টানাটানি চলছে বাম ও কংগ্রেস শিবিরের মধ্যে। এমনকী বামেদের মধ্যেও শরিকি টানাপড়েন চাগিয়ে উঠেছে।
মঙ্গলবার বিকেলে কালীগঞ্জের বেশ কিছু আরএসপি কর্মী কৃষ্ণনগরে জেলা কার্যালয়ে এসে সম্পাদকের ঘরে ঢুকে বিক্ষোভ দেখান। তাঁদের কাছে খবর, কালীগঞ্জ কেন্দ্রটি জোটের স্বার্থে কংগ্রেসকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ নদিয়া জেলায় ওই একটি কেন্দ্রেই আরএসপি-র কিছুটা শক্তি আছে এবং ওই কেন্দ্রে এত দিন তারাই প্রার্থী দিয়েছে। জেলা সম্পাদক শঙ্কর সরকার তাঁদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে নিরস্ত করেন।
যদিও ইতিমধ্যে কলকাতায় রাজ্য বামফ্রন্টের বৈঠকে কালীগঞ্জ আসনটি কংগ্রেসকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়ে যান আরএসপি নেতৃত্ব। ফলে, এ বার আর নদিয়ায় আরএসপি-র কোনও প্রার্থী থাকছেন না।
ঘটনা হল, যে ক’টি কেন্দ্রে এখনও প্রার্থী ঘোষণা হয়নি, তার সব ক’টির ক্ষেত্রেই এই টানাপড়েন রয়েছে। তবে যা-ই হোক না, জোটের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে পারে, এমন কিছু করার সম্ভাবনা এখনও কোনও পক্ষেই নেই।
যে দু’টি কেন্দ্র নিয়ে কংগ্রেস এবং বামেদের সবচেয়ে টানাটানি চলেছে, তার একটি কালীগঞ্জ হলে অন্যটি রানাঘাট দক্ষিণ।
কালীগঞ্জ
একেবারে প্রথমে কংগ্রেস যে ছ’টি আসন দাবি করেছিল কালীগঞ্জ তার মধ্যে অন্যতম। জেলায় যে ক’টি বিধানসভা এলাকায় এখনও পর্যন্ত কংগ্রেসের শক্তিশালী সংগঠন আছে, তার মধ্যে কালীগঞ্জ একটি।
সেটি ছাড়তে সিপিএমের তেমন কোনও আপত্তি ছিল না, কিন্তু অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় আরএসপি। ১৯৭১ থেকে এই কেন্দ্রে প্রার্থী দিয়ে এসেছে তারা। পাঁচ বার জিতেওছে। ২০০৬ সালে শেষ বার জিতেছিল। জেলায় এটাই তাদের এক মাত্র আসন। ফলে তারা আসনটি কোনও ভাবেই ছাড়তে রাজি হচ্ছিল না। শেষে রাজ্য নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে বরফ গলেছে।
কী অবস্থায় রয়েছে বাকি পাঁচটি আসনের হিসেব-নিকেশ?
রানাঘাট (দক্ষিণ)
এখনও পর্যন্ত দড়ি টানাটানি তুঙ্গে। কংগ্রেস ও সিপিএম, দু’পক্ষই প্রবল ভাবে আসনটি চাইছে। রানাঘাট (উত্তর-পশ্চিম) কেন্দ্রের পাশাপাশি এই কেন্দ্রটিও এক সময়ে শঙ্কর সিংহের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল। ২০১২ সালে তৃণমূলের ভরা জোয়ারেও শঙ্করের নেতৃত্বে লড়াই করে কুপার্স ক্যাম্প নোটিফায়েড এলাকায় ১২টি আসনের ১১টিতেই জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস। মমতা বন্দ্যোপাধায় ছাড়া তৃণমূলের প্রায় সব নেতা এসেও একটির বেশি আসন বের করতে পারেননি। এই বিধানসভা এলাকায় ছ’টি পঞ্চায়েতেও কংগ্রেস একক ভাবে ক্ষমতায় আছে। রানাঘাট উত্তর-পশ্চিমে শঙ্কর লড়লে তার প্রভাব পড়বে এই কেন্দ্রেও। ফলে জয়ের সম্ভাবনা আরও বাড়বে। ফলে সব মিলিয়ে এই আসন নিয়ে কংগ্রেস নেতারা অনেকটাই আশাবাদী। কিন্তু সিপিএম আসনটি হাতছাড়া করতে রাজি নয়। তবে কংগ্রেসের তরফে যে সব সওয়াল করা হচ্ছে তার অন্যতম হল, এই কেন্দ্রের বিদায়ী তৃণমূল বিধায়ক তথা প্রার্থী আবিররঞ্জন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দলেই একটি গোষ্ঠী সক্রিয়। কংগ্রেস প্রার্থী দিলে তাদের ভোট জোটের বাক্সে আসবে। কিন্তু তারা সিপিএমকে ভোট দেবে না। ফলে, পাল্লা একটু হলেও কংগ্রেসের দিকেই ঝুঁকে আছে।
শান্তিপুর
এককালের দাপুটে কংগ্রেস নেতা, তৃণমূল প্রার্থী অজয় দে-র বিরুদ্ধে লড়ার জন্য কংগ্রেসকে এই আসনটি ছাড়তে সিপিএমের তেমন আপত্তি নেই। কংগ্রেস প্রথমে ওই কেন্দ্রটি চাইলেও অজয় দে-র ভার বুঝে খুব ঝুলোঝুলি তারাও করছে না। দীর্ঘ দিন ধরে শান্তিপুর কংগ্রেসের দখলে ছিল। কিন্তু অজয় দে-র সঙ্গে সাংগঠনিক শক্তির অনেকটা তৃণমূলেই চলে গিয়েছে। তবে এই আসনের অন্যতম দাবিদার আরসিপিআই। কংগ্রেস না নিলে এই আসনটি আরসিপিআইকে দেওয়ার প্রশ্ন উঠবে।
নাকাশিপাড়া
প্রথম দিকে এই আসনটি নিয়ে কংগ্রেসের কোনও দাবি ছিল না। পরে জেলা কংগ্রেসের রাখা প্রস্তাবে নাকাশিপাড়া জোড়া হয়েছে বটে, কিন্তু সিপিএম তাতে বিশেষ আমল দিতে রাজি নয়। কারণ ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ওই কেন্দ্রে হেরে গেলেও ২০১৩-র পঞ্চায়েত ভোটে সেখানে যথেষ্ট ভাল ফল করেছে সিপিএম। কংগ্রেসের সংগঠন নেই বললেই চলে। এই আসনে নিজেদের প্রার্থী দেওয়া প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে সিপিএম।
চাকদহ ও কৃষ্ণগঞ্জ
এই দু’টি আসনই সিপিএম এবং কংগ্রেস একে অপরকে ছাড়তে চাইছে। কারণটা খুব স্পষ্ট। এই দুই আসনেই তৃণমূলের দাপট বেশি। চাকদহ প্রসঙ্গে সিপিএমের দাবি: শঙ্কর সিংহের বাড়ি ওই এলাকায় হওয়ায় এই কেন্দ্রে তাঁর কিছুটা প্রভাব রয়েছে। সিপিএমের সংগঠন তুলনায় দুর্বল। ফলে, ওখানে কংগ্রেস প্রার্থী দাঁড়ালেই বেশি সুফল পাওয়া যাবে। এতে কংগ্রেসের আসন সংখ্যাও বাড়বে। কিন্তু কংগ্রেস বিশেষ আগ্রহী নয়। ২০১৪ সালে কৃষ্ণগঞ্জ কেন্দ্রের উপনির্বাচনে সিপিএম পায় ৩৭,৬২০ ভোট, কংগ্রেস মাত্র ৪,৮১৭ ভোট। আর, তৃণমূলের সত্যজিৎ বিশ্বাস পান ৯৫,৪৬৯ ভোট। ফলে, এই কেন্দ্র নিয়ে বাম বা কংগ্রেস কারওরই কেন কোনও উৎসাহ নেই, তা কার্যত স্পষ্ট।
দুই দলই চাইছে, এখানে যেন অন্য পক্ষ দাঁড়ায়। আসন পাওয়া শুধু নয়, আসন ছাড়াটাও তো একটা লড়াই!