Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বাস ছাড়লে আজও ফেরে ভয়

করিমপুরের পান্নাদেবী কলেজ, জমশেরপুর বিএন হাইস্কুল, ধোড়াদহ হাইস্কুল, করিমপুর গার্লস হাইস্কুল, করিমপুর জগন্নাথ হাইস্কুলের তেরো থেকে আঠারো বছরের ছেলেমেয়ে সব। একটি ছাত্রীও বেরোতে পারেনি।

অতলে: ১৯৯৮ সালের ১৪ জানুয়ারি আনন্দবাজারের প্রথম পাতা। দুর্ঘটনার প্রতিবেদন ও ছবি অনল আবেদিনের।

অতলে: ১৯৯৮ সালের ১৪ জানুয়ারি আনন্দবাজারের প্রথম পাতা। দুর্ঘটনার প্রতিবেদন ও ছবি অনল আবেদিনের।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৮ ০২:৫৭
Share: Save:

নিজের জন্য একটা কম্বল আর মেয়ের জন্য চাদর কিনবেন বলে বাংলাদেশ লাগোয়া পদ্মার চর সুভদ্রা থেকে জলঙ্গি বাজারে এসেছিলেন দুখালি হালদার, সঙ্গে মেয়ে পুবালি। রাতের নৌকা ছেড়ে যাওয়ায় সে দিন আর ফিরতে পারেননি। নদী ঘেঁষা একটা খালি দোকানে থেকে গিয়েছিলেন তাঁরা। ভোরে তাঁদের কাছ ঘেঁষেই বোল্ডারে আছাড় খেয়ে নদীর দিকে গড়িয়ে যায় বাসটা।

সেই বাসটা— যেটা আগের দিন করিমপুর থেকে নানা স্কুল-কলেজের ৮০ জন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে লালবাগে পিকনিক করতে এসেছিল। হেডলাইট খারাপ থাকায় সন্ধ্যায় আর ফিরতে পারেনি। পরের দিন খুব ভোরে রওনা দিয়ে ঘন কুয়াশা ঠেলে ছুটছিল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করিমপুর ফিরে রুটে নামতে হবে যে!

দিনটা ছিল ১৪ জানুয়ারি, ১৯৯৮। ঠিক কুড়ি বছর আগের এক দিন।

করিমপুরের একটি কোচিং সেন্টার থেকে এই পিকনিকে আসা। পাঁচটি স্কুল-কলেজের ৭০ জন ছাত্র, ১০ জন ছাত্রী। সঙ্গে দুই শিক্ষক। পদ্মার ধার ঘেঁষে রাস্তা। জলঙ্গি বাজারের কাছে বড় বাঁক ছিল। রাস্তার পাশে কোনও বেড়া, খুঁটি, আড়াল ছিল না। চালকের চাদর জড়িয়ে গিয়েছিল স্টিয়ারিংয়ে। রাস্তা ছেড়ে গড়িয়ে, পাল্টি খেয়ে বাস গিয়ে পড়ে পদ্মায়। ডুবে যায়।

করিমপুরের পান্নাদেবী কলেজ, জমশেরপুর বিএন হাইস্কুল, ধোড়াদহ হাইস্কুল, করিমপুর গার্লস হাইস্কুল, করিমপুর জগন্নাথ হাইস্কুলের তেরো থেকে আঠারো বছরের ছেলেমেয়ে সব। একটি ছাত্রীও বেরোতে পারেনি। বেরোতে পারেননি পিকনিকের প্রধান উদ্যোক্তা, শিক্ষক সনাতন দে-ও। বোল্ডারে লেগে সামনের কাচ ভেঙে গিয়েছিল। সেখান দিয়ে চালক আর পাশে থাকা জনা তিনেক ছাত্র বেরিয়ে যায়। তারা যখন হাবুডুবু খেয়ে পাড়ে ওঠার চেষ্টা করছে, এক জনকে টেনে তোলেন দুখালি।

তিনি একা নন, বিকট শব্দ পেয়ে ততক্ষণে আশপাশ থেকে অনেকেই দৌড়ে এসেছেন। আপ্রাণ চেষ্টা চলছে উদ্ধারের। খানিকক্ষণের মধ্যে পুলিশ, ক্রেন, দমকল— লোকে লোকারণ্য। পদ্মার ওপারে রাজশাহি থেকে নেমে পড়েন বাংলাদেশ রাইফেলস (এখন বিজিবি)-র জওয়ানেরাও। সারা দিন ধরে একের পর এক নিথর দেহ, তার পরের দিনও— সব মিলিয়ে ৬৪।

তার পরেও এখনও প্রতি শীতে পিকনিক হয়। ওই একই রাস্তা দিয়ে ছুটে যায় বাস। জলঙ্গি বাজারের ওই বাঁক বুক-সমান উঁচু পাঁচিল ঘিরেছে। লম্বায় সোয়াশো ফুট, তারও আগে-পিছে ছোট-ছোট পিলার। এখনও শীতে গমগম করে ওঠে লালবাগর গঙ্গাতীর, হাজারদুয়ারি। দুঃস্বপ্ন পিছু ফেলে করিমপুর থেকেও বাস ছোটে এ দিক ও দিক— বেথুয়াডহরি থেকে শিকারপুর, কাছারিপাড়া।

শুধু হুল্লোড় তুলে পিকনিকের বাস ছাড়ার আগে করিমপুরের কাশিমপুর, দোগাছি, চকপাড়ার কোনও-কোনও বাবা-মায়ের বুক আজও ছ্যাঁত করে ওঠে। বারবার গিয়ে শুধু ছেলেদের বলতে থাকেন— সাবধানে যাস বাবা! কুয়াশা নামলে দাঁড়িয়ে যাস!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE