প্রতীকী ছবি।
বই ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী।
এক দিন শৌচাগারে পড়ে গিয়ে তিনি গুরুতর জখম হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। কিন্তু তখনও তাঁর পড়ার অভ্যাসে ছেদ পড়েনি। শেষ করেছেন একটার পর একটা উপন্যাস।
কখনও তাঁর স্বামী বিশ্রাম নেওয়ার কথা বললে তিনি হাসতেন। বলতেন, ‘‘বই পড়ার থেকে বড় বিশ্রাম আর কিছু হয় নাকি গো! তবে তুমি কিন্তু গ্রামের মহিলাদের জন্য বইয়ের ব্যবস্থা করবে। ওরা তো তেমন পড়ার সুযোগ পায় না।’’
স্ত্রীর মাথায় হাত রাখতেন বাসুদেব বিশ্বাস। বলতেন, ‘‘তুমি আগে সেরে ওঠো। তার পরে একসঙ্গে গ্রামে গিয়ে মেয়েদের জন্য বইয়ের ব্যবস্থা করব।’’ কিন্তু সেই শয্যা থেকে আর উঠলেন না রেণুকা বিশ্বাস। বছর তিনেক আগে বই পড়তে পড়তেই মারা গেলেন রেণুকা।
তবে স্ত্রীকে দেওয়া কথা রেখেছেন বাসুদেবও। নিজের গ্রাম, নওদার ঝাউবোনার মেয়েদের জন্য শুধু বই-ই নয়, স্ত্রীর স্মৃতিতে আস্ত একটা পাঠাগার তৈরি করে দিয়েছেন জুলাইয়ে। সেই পাঠাগারের দায়িত্বেও রয়েছেন এক মহিলা, সুমিতা চক্রবর্তী। তিনিও বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদের উৎসাহ দিচ্ছেন বই পড়ার। কখনও নিজেই হাতে করে বই পৌঁছে দিচ্ছেন।
সুমিতা বলছেন, ‘‘যাঁরা বলেন, বই বই বই আর কিছু নয়, তাঁরা ভুল বলেন। একমাত্র বই-ই পারে একটা মানুষের মনের অন্ধকার দূর করতে। রেণুকাদেবী গ্রামে এলে আমরা তাঁকে দেখতে যেতাম। তিনিও দেখা হলেই শুধু গল্প বলতেন, আর বই পড়ার পরামর্শ দিতেন। তবে মনে মনে তাঁর যে এমন স্বপ্ন ছিল তা আমরা জানতে পারি বাসুদেববাবুর মুখ থেকেই।’’
বাসুদেববাবুর জীবনের একটা দীর্ঘ সময় কেটেছে ঝাউবোনাতেই। তার পরে পাড়ি দেন বিদেশে। আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ দিন অর্থনীতি পড়িয়েছেন। পরে কিছু দিনের জন্য যান দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক সময় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
স্বামী পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও বিদেশ-বিভুঁইয়ে সময় কাটাতে অসুবিধা হত না রেণুকার। লম্বা সময় বইয়ে মুখ গুঁজে কেটে যেত তাঁর। বিদেশে গিয়েও অবশ্য শিকড়ের টান ভোলেননি ওই দম্পতি। বছরে অন্তত এক বার তাঁরা ঝাউবোনায় আসতেন।’’
বাসুদেববাবু এখন নব্বই ছুঁইছুঁই। তিনি বলছেন, ‘‘টাকার অভাবে বই কিনতে না পেরে গ্রামের কত মানুষ পড়াশোনা ছেড়ে দেন তা আমি নিজেও প্রত্যক্ষ করেছি। গ্রামে পাঠাগার থাকলেও সেখানে মেয়েরা সে ভাবে যেতেন না। এখন অন্তত মেয়েরা অনায়াসে এখানে এসে বই পড়তে পারবেন। তবে পুরুষদেরও এখানে বই পড়ার জন্য আসতে কোনও বাধা নেই। ’’
প্রাথমিক ভাবে একটি বড় ঘরে পঞ্চাশটি বই নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে ‘রেণুকা বিশ্বাস স্মৃতি পাঠাগার’। বাসুদেববাবু জানিয়েছেন, বইয়ের সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। মহিলারাও এখন ওই পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক। গ্রামের শিক্ষক সৌমিত্র চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘গ্রামের মহিলারাই মূলত পাঠাগার পরিচালনা করছেন। পাঠাগারের সদস্যপদ পেতে কোনও টাকা লাগছে না। সদস্য কার্ড দেখালেই বই নেওয়া যাবে। বাসুদেববাবু নিজেদের যাবতীয় বইপত্রও পাঠাগারকে দান করছেন। নভেম্বরে আরও অনেক বই আসবে।’’
গ্রামের সঞ্চিতা বিশ্বাস, মাধবীলতা মণ্ডলেরা বলছেন, ‘‘সেই কবে স্কুলের বই পড়েছি। এখন আবার সংসারের কাজ সামলে গাঁয়ের লাইব্রেরি থেকে আনা বই পড়ছি। ভাবতেই পারিনি, আমরা আবার গল্পের বই পড়ব!’’ এখন রাত জেগে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছেন সঞ্চিতা, মাধবীলতারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy