Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

দু’আনার দুলের জন্য খুন সরিফা

বছর সাতেকের ছটফটে মেয়েটাকে পছন্দ করত গোটা পাড়া। দুদ্দাড় পায়ে পাড়ার এ বাড়ি থেকে আর এক বাড়ি ছুটে বেড়াত সে।রবিবার সকালেও জলঙ্গির কুতুবপুরের সরিফা খাতুন এক ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল।

শোকার্ত পরিজনেরা। ইনসেটে, সরিফা। — নিজস্ব চিত্র

শোকার্ত পরিজনেরা। ইনসেটে, সরিফা। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
ডোমকল শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:১৬
Share: Save:

বছর সাতেকের ছটফটে মেয়েটাকে পছন্দ করত গোটা পাড়া। দুদ্দাড় পায়ে পাড়ার এ বাড়ি থেকে আর এক বাড়ি ছুটে বেড়াত সে।

রবিবার সকালেও জলঙ্গির কুতুবপুরের সরিফা খাতুন এক ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল—‘‘মা, কেয়া দাদির বাড়ি যাচ্ছি। আম দেবে বলেছে।’’ বিরক্ত হয়েই ঝর্ণা বিবি বলেছিলেন, ‘‘বাড়িতে একটু স্থির হয়ে বসতে পারিস না! সব সময় শুধু পাড়া বেড়ানো।’’ কিন্তু সে কথা মেয়ের কানে গেলে তো!

সেই মেয়ে যে আর কোনও দিন ঘরে ফিরবে না কে জানত! সোমবার প্রতিবেশী ‘কেয়া দাদি’ ওরফে নূরজাহান বিবির বাড়ি লাগোয়া একটি পুকুর থেকে পুলিশ সরিফার দেহ উদ্ধার করেছে। তার শরীরের একাধিক জায়গায় রয়েছে আঘাতের চিহ্ন। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে সরিফাকে। খুন ও অপহরণের অভিযোগে পুলিশ নূরজাহানকে গ্রেফতারও করেছে। মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, ‘‘ওই মহিলাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে খুনের কারণ জানারও চেষ্টা চলছে।’’

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রবিবার সকাল ন’টা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল সরিফা। যাওয়ার সময় সে বলে গিয়েছিল নূরজাহানের বাড়িতে যাচ্ছে আম আনতে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, তারপর সন্ধ্যা নামে। কিন্তু সরিফা বাড়ি ফেরেনি। ঝর্ণা বিবি বাড়ির সবাইকে জানান যে, সরিফা নূরজাহানের বাড়িতে আম আনতে যাচ্ছে বলে বেরিয়েছিল। সকলে তখন ওই মহিলার বাড়িতে যান। অভিযোগ, নূরজাহান তাঁদের কাউকেই বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। উল্টে হাঁসুয়া নিয়ে তাড়া করে।

ওই মহিলার এমন আচরণে সকলের সন্দেহ হয়। তারপর ওই রাতেই জলঙ্গি থানায় নূরজাহানের বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ দায়ের করেন সরিফার বাবা শরিফুল। অভিযোগ পেয়েই তদন্তে নামে পুলিশ। এমনকী রাতে নূরজাহানের বাড়ির চার পাশে পুলিশি প্রহরার ব্যবস্থাও করা হয়। সোমবার সকালে নূরজাহানের বাড়ি লাগোয়া পুকুরে মেলে সরিফার দেহ। এরপরেই ক্ষোভে ফেটে পড়ে কুতুবপুর। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, রবিবার নূরজাহান তার বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেয়নি। বাড়ির মূল ফটকে হাঁসুয়া নিয়ে বসেছিল।

কিন্তু সরিফাকে খুন করা হল কেন?

পুলিশ জানিয়েছে, ধৃত নূরজাহানকে জেরা করে এই প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা চলছে। তবে সরিফার বাবা শরিফুল শেখের দাবি, ‘‘মেয়ের কানে একজোড়া সোনার দুল ছিল। কিন্তু দেহ উদ্ধারের পরে সেই দুল পাওয়া যায়নি। ওই দুলের লোভেই নূরজাহান আমার মেয়েটাকে খুন করেছে।’’ কাঁটাবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য কংগ্রেসের তাপস প্রামাণিক বলেন, ‘‘ওই মহিলাকে নিয়ে এলাকায় অনেক অভিযোগ আছে। তাছাড়া রবিবার তার আচরণ মোটেই সুবিধার ছিল না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আমাদেরও সন্দেহ সরিফার সোনার দুলজোড়া হাতাতেই ওই মহিলা এমন কাণ্ড করেছেন। তাছাড়া রবিবার ওর বাড়িতে সরিফাকে অনেকেই যেতে দেখেছেন। কিন্তু কেউ সেখান থেকে বেরোতে দেখেননি। এমনকী আমরাও বাড়িতে ঢুকতে চাইলে হাঁসুয়া নিয়ে তাড়া করেন ওই মহিলা।’’

পুলিশের অনুমান, রবিবার সন্ধ্যায় পুলিশ যাওয়ার আগেই হয়ত সরিফাকে খুন করে তার দেহ পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এলাকার বাসিন্দা গোলাম রেজাউল সরকার বলেন, ‘‘এ দিন সকালে ওই পুকুরের মালিক আজমত মণ্ডল পুকুরে জল দিতে গিয়েই দেহটি দেখতে পেয়ে সবাইকে জানান।’’

শরিফুল পেশায় দিনমজুর। স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে অভাবের সংসার। এ বছরেই কুতুবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল সরিফা। পাড়ার ছটফটে মেয়েটার এমন পরিণতি দেখে শোকস্তব্ধ কুতুবপুর। পড়শিরা বলছেন, ‘‘ভাবতেই পারছি না মেয়েটা আর নেই। সারাটা দিন ছোটাছুটি করে পাড়া মাত করে রাখত। ওকে যে এ ভাবে খুন করেছে তার কঠিন শাস্তি চাই।’’

ঝর্ণা বিবি এ দিন কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। বাড়ির সদর দরজার দিকে চেয়ে মাঝেমধ্যেই জানতে চেয়েছেন, ‘‘সরিফা এল নাকি?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ear ring minor girl
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE