Advertisement
১৬ মে ২০২৪
Duttapukur Blast Suspect

কাপড়ের গাঁটরির ফাঁকে বস্তায় মুড়ে পাচার হত ‘বাজি’র মশলা, সিন্ডিকেটে জোগান দেওয়া হত শ্রমিকও

ভোরের আকাশ ফর্সা হওয়ার আগেই ছোট ছোট পিকআপ ভ্যানে কাপড়ের গাঁটরির আড়ালে বস্তায় মুড়ে বোমার মশলা এসে ঢুকত জেরাতের ডেরায়। আর সন্ধে নামলেই গোডাউনের সামনে এসে দাঁড়াত বড় বড় ট্রাক।

বিস্ফোরণের পর দত্তপুকুরের সেই বাড়ি। যার ভিতরে চলত বাজি বানানোর কাজ।

বিস্ফোরণের পর দত্তপুকুরের সেই বাড়ি। যার ভিতরে চলত বাজি বানানোর কাজ। —ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
সুতি শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০২৩ ১১:২৬
Share: Save:

গ্রামের বাজারে ছোট্ট একখানি কাপড়ের দোকান। পসার বলতে গ্রামের মেয়েদের পরার মামুলি আটপৌরে শাড়ি আর সাধারণ গামছা-লুঙ্গি। এ ছাড়া আর তেমন কিছুই পাওয়া যায় না দোকানে। ফলে খরিদ্দারেরও দেখা বড় একটা মেলে না। এ দোকানে কখনও দিনে হাজারখানেকের বেশি ব্যবসা হয়েছে বলে মনে করেন না স্থানীয়রা। তবে ব্যবসার হাল যা-ই হোক, ব্যবসায়ীর রমরমা তাতে আটকায়নি। মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান, জঙ্গিপুর, সুতি এমনকি, বহরমপুরের প্রাণকেন্দ্রেও নাকি ওই ছোট্ট কাপড়ের দোকানি নামে-বেনামে একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক। রয়েছে জমি-জিরেতও। অন্তত তেমনই দাবি করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁরাই জানাচ্ছেন, এই সম্পত্তির রমরমা হয়েছে গত কয়েক বছরের মধ্যে! তার আগে নিতান্তই সাধারণ ছিলেন জেরাত আলি। এখন অবশ্য তাঁর দাপটে এলাকায় মুখ খুলতেও ভয় পায় অনেকে।

রবিবার উত্তর ২৪ পরগণার দত্তপুকুরে যে বিস্ফোরণ হয়েছে, তার তদন্তে এই জেরাতের নামই উঠে এসেছে বলে পুলিশ সূত্রে খবর। দত্তপুকুরে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ছ’জনেরই বাড়ি মুর্শিদাবাদে বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। তাদের সন্দেহ, এই শ্রমিকদের মুর্শিদাবাদ থেকে জেরাতই পাঠিয়েছিল দত্তপুকুরে বাজির কারখানায় কাজ করতে। স্থানীয়দের দাবি, নিজেকে কাপড়ের ব্যবসায়ী হিসাবে দেখালেও জেরাতের রকেটগতিতে উত্থানের নেপথ্যে আসলে ছিল ‘বোমা মশলা এবং বোমা বানানো শ্রমিক সরবরাহের সিন্ডিকেট’।

কী ভাবে চলত সেই সিন্ডিকেট? স্থানীয় এক ব্যক্তির দাবি, ‘‘ভোরের আকাশ ফর্সা হওয়ার আগেই ছোট ছোট পিকআপ ভ্যানে কাপড়ের গাঁটরির আড়ালে বড় বড় সেলাই করা বস্তায় ঝাড়খণ্ড থেকে বোমার মশলা এসে ঢুকত জেরাতের ডেরায়। আর সন্ধে নামলেই গোডাউনের সামনে এসে দাঁড়াত ১০ চাকা কিংবা ১৬ চাকার বড় ট্রাক। কয়েক ঘণ্টায় ফাঁকা হয়ে যেত জেরাতের মজুতঘর।’’

এর আগেও জেলার একাধিক বিস্ফোরণকাণ্ডে নাম উঠে এসেছে জেরাতের। এনআইয়ের নজরও ছিল জেরাতের উপর। এ বার দত্তপুকুর বিস্ফোরণকাণ্ডেও গোয়েন্দাদের নজরে সেই জেরাত। তদন্তকারীদের সন্দেহ, দত্তপুকুরে বাজি বানানোর দক্ষ শ্রমিক সরবরাহ থেকে মশলার জোগান দেওয়া— সবটাই মুর্শিদাবাদে বসে একাই সামলাতেন জেরাত। দত্তপুকুরে মুর্শিদাবাদের চার শ্রমিকের মৃত্যুতে সেই তত্ত্ব আরও জোরালো হচ্ছে।

দত্তপুকুরের বিস্ফোরণে এখনও পর্যন্ত অন্তত ন’জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। স্থানীয় সূত্রে খবর, মূল অভিযুক্ত কেরামতের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর পুত্র রবিউল এবং যে বাড়িটি ভাড়া নিয়ে বাজি বানানোর কাজ চলত, সেই বাড়ির মালিক সামসুল হকেরও মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ সূত্রে খবর মৃতদের বাকি ছ’জনের বাড়ি মুর্শিদাবাদের নতুন চাঁদরা গ্রামে। এই ৬ জন হলেন, আন্দাজ শেখ ( ২০ ), ছোটন শেখ ( ১৫ ) , হাবিব শেখ (৪০ ) , রনি শেখ ( ২০), সুজন শেখ (২২) এবং রাফিযুল শেখ। পুলিশ সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই এলাকা থেকে আরও বেশ কয়েক জন শ্রমিক ওই দত্তপুকুরের কারখানায় কাজ করতেন। তবে তাঁদের খোঁজ এখনও মেলেনি।

দত্তপুকুর বিস্ফোরণের ঘটনায় কী ভাবে জড়িত জেরাত? জেরাতের প্রতিবেশী রহমান শেখের দাবি, ‘‘দীর্ঘ দিন ধরে বোমা তৈরি করত জেরাত। কাপড়ের ব্যবসা শুধু দেখানোর জন্য। এখন বোমার মশলার ব্যবসা শুরু করে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি করেছে। ভয়ে কারওর মুখ খোলার উপায় নেই।’’ নিহত শ্রমিক পরিবারের এক সদস্য রেহানা পারভিন আবার জানিয়েছেন, ‘‘বেশি রোজগারের লোভ দেখিয়ে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে জেরাত আমার বাবাকে কাজে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোথায় কাজ, তা বাড়ির কাউকে জানানোর নিয়ম ছিল না। এমনকি, বাবাকে তাঁর ফোনে ফোনও করতে পারতাম না আমরা। জেরাতের দেওয়া নম্বরেই কথা বলতে হত।’’

তদন্তকারী সূত্রে জানা যাচ্ছে, বড় বিস্ফোরণ ক্ষমতাযুক্ত বোমার মশলা থেকে সাধারণ শব্দবাজির মশলা— সবই সরবরাহের অন্যতম মূল পাণ্ডা মুর্শিদাবাদের জেরাত। বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের একাধিক জায়গা থেকে তাঁর মাধ্যমেই বোমা তৈরির মশলা চলে যেত উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন এমন বাজি কারখানায়।

মুর্শিদাবাদের একটি বিস্ফোরণ মামলায় বেশ কিছু দিন আগেই পুলিশ গ্রেফতার করে জেরাতকে। এক মাস জেলবন্দি থাকার পর মাসখানেক আগেই জামিনে মুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, জেল বা গ্রেফতারিকে যে মোটেই রেয়াত করে না জেরাত, তার প্রমাণ দত্তপুকুরের ঘটনা। কারণ, এ ক্ষেত্রেও আবার ঘুরেফিরে সেই তাঁরই নাম উঠে আসছে তদন্তে।

জেরাত প্রসঙ্গে পুলিশকে প্রশ্ন করা হলে জঙ্গিপুর পুলিশ জেলা সুপার সতীশ জানিয়েছেন, ‘‘তদন্তের স্বার্থে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে এটুকু জানাব— বিস্ফোরণকাণ্ডের অন্যতম পাণ্ডা হিসেবে মুর্শিদাবাদের এক জনের নাম উঠে আসছে। তার ব্যাপারে জেলা পুলিশের গোয়েন্দারা তথ্য সংগ্রহ করছে। আমরা গোটা ব্যাপারটার উপরেই নজর রাখছি। উত্তর ২৪ পরগনা পুলিশের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dattapukur Blast suspect
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE