সে একটা সময় ছিল। নবদ্বীপের ঘুম ভাঙত হাতে চালানো তাঁতের ঠকাঠক শব্দে। শহরের চারপাশ ঘিরে গঙ্গার তীর বরাবর শুধুই তাঁতঘর তখন। মন্দিরনগরীর অলিতে গলিতে ছড়ানো কয়েকশো মঠমন্দিরে সন্ধ্যারতির কাঁসর-ঘণ্টার শব্দে নামত সন্ধ্যা। আরও আগে, চতুষ্পাঠীময় নবদ্বীপের গঙ্গার ঘাট সূর্যোদয় থেকেই মুখর হয়ে উঠত দেশবিদেশের ছাত্র এবং অধ্যাপকদের নব্যন্যায় চর্চায়। নবদ্বীপ তখন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। গঙ্গার তীরবর্তী ঘাটগুলিতেই বসত তর্কযুদ্ধের আসর। নবদ্বীপের ইতিহাস বলে গঙ্গার এমনই একঘাটে তর্কযুদ্ধে তার্কিক কেশবকাশ্মীরিকে পরাজিত করেছিলেন শহরের তরুণ পণ্ডিত বিশ্বম্ভর মিশ্র। তখনও তিনি মহাপ্রভু হয়ে ওঠেননি।
নবদ্বীপের গঙ্গা দিয়ে তারপর বয়ে গিয়েছে অনেক জল। এখনও সন্ধ্যে নামলেই গঙ্গার ধারের নিরিবিলিতে জমে ওঠে ছোট ছোট আসর। বলাবাহুল্য তাঁতের সুতোর টানাপোড়েন কিংবা বিদ্যাচর্চা কোনওটাই এখানে হয় না। বরং এসব আসরে চলে অফুরন্ত মদের ফোয়ারা। সঙ্গে গাঁজা থেকে ডেনড্রাইট, চাইলে সবই মেলে। নদী পাড়ের নির্জন ঘাটগুলির এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে পড়তে থাকে ঝাঁ চকচকে সব মোটরবাইক। দামি স্মার্টফোন, জিন্স পড়া আরোহীর সন্ধ্যা নামতেই দল বেঁধে হাজির। বাইকের পেট থেকে বেড়িয়ে আসে বোতল। তার পর আকণ্ঠ নেশায় ডুবে যাওয়া। রাত যত বাড়ে গঙ্গার ফুরফুরে হাওয়ায় নেশার মৌতাত ততই জমে ওঠে। কিংবা ষ্টেশন চত্বর ছাড়িয়ে যেখানে প্লাটফর্ম মিশেছে রেল লাইনের গায়ে। তুলনায় জনসমাগম কম, আলো আধাঁরিতে ভরা এমন জায়গা বেছে নিত্য জমে ওঠে আসর। হাজির থাকে আঠারো থেকে আটষট্টি।
প্রাচীন মায়াপুর থেকে প্রতাপনগর কিংবা ষ্টেশন থেকে গঙ্গার ঘাট। সন্ধ্যা নামলে এ ভাবেই বদলে যাচ্ছে নবদ্বীপ শহরের চালচিত্র। নবদ্বীপকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে গঙ্গা এবং রেললাইন। শহরের পূর্ব এবং উত্তর দিক জুড়ে বইছে গঙ্গা। অন্য দিকে দক্ষিণ এবং পশ্চিম দিক বরাবর নবদ্বীপ শহরকে বেঁধে রেখেছে রেললাইন। রেললাইন পার হলেই বর্ধমান। সারা দিনের ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্যান্য কাজ সেরে সন্ধ্যা নামতেই পূর্বস্থলী, শ্রীরামপুর, হেমাতপুর, বিদ্যানগর, পারুলিয়ার মতো বর্ধমানের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাইকে করে চলে আসে নেশারুর দল। নবদ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় থাকে তাদের নবদ্বীপের বন্ধুরা। তারপর নবদ্বীপে গঙ্গার অসংখ্য ঘাটের কোনও একটা পাড়ে জমিয়ে জুত করে বসে পড়তে পারলেই হল।
এ ভাবেই নবদ্বীপের পূর্ব দিকের প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার লম্বা গঙ্গার তীরবর্তী পোড়াঘাট, ফাঁসিতলা, শ্রীবাসঅঙ্গন ঘাট, দণ্ডপাণিতলা ঘাট, মণিপুর ঘাট এবং সর্বশেষ শ্মশান ঘাট চত্বর জুড়ে মদ-গাঁজা সহ বিভিন্ন নেশার বাড়বাড়ন্তে উদ্বিগ্ন শহরের মানুষ। একই ছবি নবদ্বীপ ষ্টেশন বা বিষ্ণুপ্রিয়া হল্ট সংলগ্ন এলাকাতেও। তবে শুধু মদই নয়। শহরের নেশার ঠেকে মিলছে ডেনড্রাইট, ক্যান বিয়ার, গাঁজার পুরিয়া সবই। বৃষ্টি না হলে শহরের বিভিন্ন খেলার মাঠও ঠেক হিসাবে খুব পছন্দ নেশারুদের। তার সঙ্গে দোসর সাট্টা-জুয়া। সকাল থেকেই দফায় দফায় চলে নম্বর নির্ভর সাট্টা। আর এই সব জায়গায় যারা যাতায়াত করেন, তাঁদের একটা বড় অংশ সম্পন্ন পরিবারের ছেলে।
বিষয়টি কপালে ভাঁজ ফেলছে শাসকদলের কর্তাদেরও। সম্প্রতি এই সবের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ মিছিলে সামিল হয়েছিলেন নবদ্বীপের বিধায়ক এবং পুরপ্রধান। সঙ্গে ছিলেন একাধিক মঠমন্দিরের প্রধান-সহ বিভিন্ন স্তরের পুরুষ এবং মহিলারা। প্রসঙ্গত তৃণমূলের যে কোনও মিছিল বড়ালঘাট বা নবদ্বীপ তাঁতকাপড় হাট থেকে শুরু হলেও মদ বিরোধী এই মিছিলটি শুরু হয়েছিল শ্রীবাসঅঙ্গন ঘাট থেকে। যে এলাকায় নেশারুদের নিত্য যাতায়াত। নবদ্বীপের বিধায়ক পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা সাফ বলেন, “আমরা কাছে যে কোনও নেশাই ঘৃণার বস্তু। কোনও দিন বরদাস্ত করিনি, আজও করব না। যারা যুক্ত তাঁদের সতর্ক করার জন্যই এই মিছিল। আশা করব তাঁরা নিজেরা সংশোধন হবেন।”
কিন্তু শহরে নেশার এমন বাড়বাড়ন্ত কেন? নবদ্বীপের পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহা মনে করেন, বদলে যাওয়া এই সময়ে মদ খাওয়াটাই যেন ক্রমশ স্ট্যাটাস সিম্বল হয়ে উঠছে। নতুন প্রজন্মের কাছে মদ্যপানই আধুনিকতার সংজ্ঞা। নবদ্বীপও সেই প্রভাব মুক্ত নয়। তাঁর কথায়, “যে কোনও নেশাই সামাজিক দূষণ ছড়ায়। যাঁরা এসবের সঙ্গে যুক্ত তাঁরাও সেটা জানেন।” পুলিশের বক্তব্য, তাঁরা নিয়মিত বিভিন্ন জায়গায় হানা দিয়ে প্রচুর সংখ্যায় ধরপাকড় করছেন।
তাতেও আসর জমাতে কসুর করছেন না নবীনপ্রবীণ নেশারুর দল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy