বিধায়ক রুকবানুর রহমান। নিজস্ব চিত্র।
যে যে শর্ত পূরণ করলে তালিকায় নাম থাকা উচিত, তার প্রায় কোনওটাই নেই ওঁদের। অথচ শর্তপূরণ করাদের পাশাপাশি তালিকায় নাম রয়েছে তাঁদেরও। নদিয়ার চাপড়া বিধানসভা এলাকার একাধিক পঞ্চায়েত সদস্য এবং তাঁদের স্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ— অসহায়, সহায়সম্বলহীন, দুঃস্থ সংখ্যালঘু মহিলাদের জন্য রাজ্য সরকারের যে আবাসন প্রকল্প রয়েছে, সেই প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন তাঁরা। এলাকার বাসিন্দাদের পাশাপাশি বিরোধী দলগুলোও এমন অভিযোগে সরব হয়েছে। স্থানীয় বিধায়কের বিরুদ্ধে উঠেছে স্বজনপোষণের অভিযোগ। যদিও যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা প্রত্যেকেই বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। এলাকার বিধায়কও রুকবানুর রহমানও মানেননি অভিযোগের কথা।
পারুল পরভীন। চাপড়ার হৃদয়পুর পঞ্চায়েতের সদস্য। এলাকায় কান পাতলে শোনা যায়, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া তাঁর কৃষি জমির পরিমাণ অন্তত আড়াই বিঘা। যার বাজারমূল্য প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা। পেল্লায় বাড়ি। স্বামীর দীর্ঘ দিনের পারিবারিক ব্যবসা। বছরে লেনদেন ২০ লক্ষের মতো। বৈভবের কোনও খামতিই নেই পারিবারিক ভাবে। তিনি নিজে আবার নদিয়ার চাপড়া বিধানসভার হৃদয়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য। এ হেন পারুল পারভিনের বিরুদ্ধে অসহায়-সম্বলহীন, দুঃস্থ সংখ্যালঘু মহিলাদের আবাসন প্রকল্পের সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ উঠল। শুধু তিনি নন, অভিযোগ, সরকারি ওই প্রকল্পের সুবিধা প্রাপকদের তালিকায় নাম রয়েছে হৃদয়পুরেরই অন্য দুই তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যের স্ত্রীদের। ওই সদস্যেরা হলেন, আফজাল শেখ ও খেদের আলি মণ্ডল। যাঁদের সম্পত্তির বহর গোটা এলাকারই ঈর্ষার কারণ।
রাজ্য সরকারের সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের তহবিল থেকে অসহায়, দুঃস্থ, সহায়-সম্বলহীন ও স্বামী পরিত্যক্তা অথবা বিধবা মহিলাদের জন্য সরকারি আবাসন প্রকল্প চালু করা হয়েছে। সাধারণত স্থানীয় বিধায়ক ও পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির কাছে করা আবেদনের ভিত্তিতে তালিকা তৈরি করা হয়। নিয়ম হল, সংশ্লিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েত এবং স্থানীয় বিডিও যৌথ ভাবে আবেদনকারীদের সমস্ত নথি যাচাই করেন। তার পরেই ঠিক হয়, কে এই প্রকল্পের সুবিধা পাবেন। কড়া নিয়মের বেড়াজাল সত্ত্বেও এই প্রকল্পের সুবিধা-প্রাপকদের তালিকায় একাধিক বেনিয়মের অভিযোগ উঠেছে চাপড়ায়।
অভিযোগ, ১০৯ জনের যে তালিকা তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে অন্তত ৭৫ জন এমন রয়েছেন, যাঁরা কোনও মানদণ্ডেই সহায়-সম্বলহীন নন। এর মধ্যে বেশির ভাগই চাপড়ার হাতিশালা পঞ্চায়েতের বাসিন্দা। চাপড়া ১ নম্বর, চাপড়া ২ নম্বর, আলফা, কলিঙ্গের পাশাপাশি হৃদয়পুরেরও কয়েক জন রয়েছেন। তাঁর মধ্যেই রয়েছেন পারুল, আফজাল ও খেদেররা। আবাসন প্রকল্পের সুবিধা পাওয়া নিয়ে বিতর্ক তৈরি হতেই পারভিনের স্বামী রবিউল মোল্লা বলছেন, ‘‘ঘর আছে অনেক দিনের পুরনো। একটা সরকারি ঘর পেলে ভালই হয়।’’ এই প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন খেদেরও। বিতর্কের কথা শুনে মুচকি হেসে তিনি বলেন, ‘‘এক পয়সাও নিই না তো। তাই বলে একটা ঘর নেব না?’’
যদিও এই গোটা বিতর্ক তাঁর কোনও ভূমিকা নেই বলে দাবি করেছেন রুকবানুর। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘আমার কাছে আবেদন করেছিলেন অনেকে। আমি তার ভিত্তিতে একটি তালিকা প্রস্তুত করে ব্লকে পাঠাই। ব্লকের দায়িত্ব, নথি যাচাই করে সঠিক তালিকা প্রস্তুত করা। যদি কিছু ভুল ত্রুটি হয়ে থাকে, তার দায় কোনও ভাবেই আমার না।’’
চাপড়ার বিডিও দীনেশ দে যদিও বিধায়কের বক্তব্য মানতে নারাজ। তাঁর কথায়, ‘‘এখানে ব্লক অফিসের কিছু করার নেই। বিধায়ক যেমন তালিকা করে দেন, আমরা তেমনই পঞ্চায়েতে পাঠাই। সঠিক উপভোক্তাদের হাতে পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব সম্পূর্ণ পঞ্চায়েতের। দায় আমাদের নয়।’’
অন্য দিকে, হাতিশালা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কল্যাণী দাস বলছেন, ‘‘যে তালিকা আমাদের কাছে এসেছিল, সেই তালিকা ধরে কাগজপত্র চেয়ে পাঠানো হয়। যাদের কাগজপত্র সঠিক এসেছিল তাদের নাম ব্লকে গিয়েছে। তার পর সেখানে কী হয়েছে, সেটা বলতে পারব না।’’
চাপড়ায় রাজ্য সরকারের ওই প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিজেপির নদিয়া উত্তর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি অর্জুন বিশ্বাস। তাঁর কথায়, ‘‘কৃষ্ণনগর থেকে করিমপুর, বলা ভাল গোটা রাজ্যেই তৃণমূল বিধায়ক ও পঞ্চায়েত সদস্যদের দুর্নীতি আর নতুন কী!’’
তালিকায় রয়েছে হৃদয়পুরেরই বিউটি খাতুনের নাম। এলাকাবাসীর দাবি, তিনি প্রকৃতই সহায়-সম্বলহীন সংখ্যালঘু মহিলা। সেই বিউটি বলছেন, ‘‘এ সবের চক্করে আমার প্রাপ্য টাকা যেন না মার যায়! সেটাই এখন চিন্তার।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy