Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
কুয়াশায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস পড়ল নয়ানজুলিতে, মৃত ৯

তলিয়ে গেল মাথাগুলো

বেশির ভাগ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই যা হয়, চালক আগেই লাফ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাকিরা পারেননি। বাসের যে দিকটা জলে ডুবে গিয়েছিল সেখানে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যান কয়েক জন। বাকি অনেকেই ভাল মতো চোট পান।

স্বজন হারানোর কান্না। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে। ছবি: গৌতম প্রামাণিক

স্বজন হারানোর কান্না। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে। ছবি: গৌতম প্রামাণিক

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৮ ০২:১১
Share: Save:

বাসটা ছেড়েছিল ভোর পৌনে ৪টে নাগাদ, নওদার রাধানগর থেকে। যাবে বহরমপুর। ভিতরে জনা পঞ্চাশ যাত্রী। তাঁদের কেউ ছোট কারবারি, কেউ মজুর, কেউ চলেছেন ডাক্তার দেখাতে। কেউ বা বেলডাঙা স্টেশন থেকে ট্রেন ধরবেন।

শনিবার, ভোর ৫টা।

চারদিক কুয়াশায় সাদা। হেডলাইট জ্বেলে আমতলা-বেলডাঙা সড়ক ধরে ছুটছে বাস। বেলডাঙার দিকে যেতে বেগুনবাড়ি মোড় পার করে হঠাৎই উল্টো দিকে থেকে আসা লরির মুখোমুখি পড়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন চালক। রাস্তা ছেড়ে সোজা বাঁ দিকের নয়ানজুলিতে গিয়ে পড়ল বাস। সামনেটা ডুবে গেল।

তখনও আঁধার কাটেনি। এলাকার বেশি লোক টেরও পায়নি। খানিক পরে স্বরূপনগর জুম্মা মসজিদে খবর যায়। সেখান থেকে মাইকে ঘোষণা করা হয়। তার পরেই দুদ্দাড় করে যে যেখানে ছিল, দৌড়ে আসতে থাকে।

বেশির ভাগ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই যা হয়, চালক আগেই লাফ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাকিরা পারেননি। বাসের যে দিকটা জলে ডুবে গিয়েছিল সেখানে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যান কয়েক জন। বাকি অনেকেই ভাল মতো চোট পান। তার উপর কনকনে জল আর উত্তুরে হাওয়া। তাতেও কয়েক জন অসুস্থ হয়ে পড়েন।

নওদার আমতলা থেকে বাসে উঠেছিলেন আইনুল হক। তাঁর কথায়, ‘‘বেশির ভাগ যাত্রীই বসে ছিল। কয়েক জন দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাসটা মোটামুটি গতিতে যাচ্ছিল। বেগুনবাড়ি পেরিয়েই হঠাৎ বাঁ দিকে জলে গিয়ে পড়ল। রাস্তা ভাঙা ছিল। কুয়াশায় পাশের নয়ানজুলি ঠিক বোঝাও যাচ্ছিল না।’’ প্রাণে বাঁচলেও তাঁর মাথা ফেটেছে। বেলডাঙা গ্রামীণ হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা হয়েছে।

ভোরের রাস্তায় এমন ঘটনা তো নতুন নয়! বছর ছয়েক আগে এই জানুয়ারি মাসেই নদিয়া থেকে বিয়ে সেরে গাড়িতে ফিরছিলেন বর-কনে। বরের বাবা ও পরিজনরা অন্য গাড়িতে। গন্তব্য লালগোলার কৃষ্ণপুর। গাড়ির হেডলাইটেও কুয়াশা কাটছিল না। বর-কনের গাড়ি বেরিয়ে গেলেও অন্য গাড়িটি পড়ল নয়ানজুলিতে। লালগোলার রতন ঘোষের কথায়, ‘‘ওই গাড়ির সাত জনই শেষ।’’

বিশ বছর আগে জানুয়ারিতেই লালগোলা থেকে পিকনিক সেরে ফেরার সময়ে জলঙ্গি বাজারের কাছে বাঁক বুঝতে না পেরে সোজা পদ্মায় গিয়ে পড়েছিল পিকনিকের বাস। করিমপুরের একটি কোচিং সেন্টারের পড়ুয়া ও শিক্ষকেরা ছিলেন তাতে। ৬৪ জন জীবন শেষ।

সাগরদিঘির রতনপুর মোড়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে ধাবায় কাজ করতেন নীলাদ্রি হালদার। পৌষ সংক্রান্তি এলেই তাঁর মনে পড়ে, সে সকালটা ছিল ঘন কুয়াশায় মোড়া। তিন হাত দূরের জিনিসও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। ‘‘নতুন গাড়ি তারাপীঠে পুজো দিয়ে সপরিবার ফিরছিলেন নাকাশিপাড়ার ব্যবসায়ী আহিরলাল দাস। ট্রেলারের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা। বাঁচানোর সময়টুকুও মেলেনি। সাত বছরের মেয়েটার ফুলের মতো মুখটা খুব মনে পড়ে’’— বলছেন নীলাদ্রি।

একই আক্ষেপ এ বারের দুর্ঘটনার পরেও। সকালেই বেলডাঙা থানায় পৌঁছে যান নওদার বিধায়ক আবু তাহের খান এবং বেলডাঙার বিধায়ক সফিউজ্জামান। আবু তাহেরের খেদ, ‘‘নওদা থেকে বেলডাঙার রাস্তা দীর্ঘ দিন ভাঙা। এই দুর্ঘটনার জন্য কুয়াশা এবং বেহাল রাস্তা, দুই-ই দায়ী।’’

সেই দায় যে কে নেবে, আর কত প্রাণ গেলে যে পরিস্থিতি বদলাবে, তা অবশ্য কেউই জানে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bus Accident Accident Fog Naoda Killed dead
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE