Advertisement
E-Paper

কফিনে কেউ ঘরে ফেরে, ফুঁপিয়ে কাঁদছে গ্রাম

একটা বাড়ি চেয়েছিলেন তিনি। নিজের পরিবারের জন্য, প্রিয়জনদের জন্য। সেই বাড়ির ছাদ ঢালাই হয়েছে সোমবারেই। মাঝে কেবল দু’টো রাত, বুধবার সকালেই তিনি ফিরছেন। তবে কফিনবন্দি হয়ে।

সুস্মিত হালদার

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৬ ০৩:১৪
স্বজনহারা শোক। চাপড়ার জামরেনগরে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

স্বজনহারা শোক। চাপড়ার জামরেনগরে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

একটা বাড়ি চেয়েছিলেন তিনি। নিজের পরিবারের জন্য, প্রিয়জনদের জন্য। সেই বাড়ির ছাদ ঢালাই হয়েছে সোমবারেই। মাঝে কেবল দু’টো রাত, বুধবার সকালেই তিনি ফিরছেন। তবে কফিনবন্দি হয়ে।

মঙ্গলবার সকালেই এসেছিল ফোনটা। সেই ফোন জানিয়ে দিয়েছে, বিহারের গয়ায় মাওবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ গিয়েছে কোবরা বাহিনীর জওয়ান চাপড়ার জামরেনগরের দীপক ঘোষের।

যে উঠোন থেকে আধা সামরিক বাহিনীর জীবনের সূচনা, এ দিন দুপুরে দেখা গেল সেই উঠোনে তিল মাত্র জায়গা নেই। বাড়ির দাওয়ার এক কোণে কেঁদে চলেছেন দীপকের স্ত্রী দেবশ্রী। নাগাড়ে বিড় বিড় করছেন, ‘‘কফিনে কেউ ঘরে ফেরে!’’

তিনি তো বটেই, বাড়ির কেউই বিশ্বাস করতে পারছেন না, ৪৮ ঘণ্টা আগেই যে ছেলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা বলেছিলেন, কী করে সে কফিন বন্দি হয়ে বাড়ি ফিরতে পারে!

বাবা নেপাল ঘোষ ছিলেন দিনমজুর। বিঘে দেড়েক জমিতে ঠিক মতো সংসার চলত না। পড়শিরা বলছেন, শপথটা তখনই করেছিলেন দীপক— যেমন করেই হোক চাকরি তাঁকে পেতেই হবে।

মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর থেকেই শুরু হয় সেই লড়াই। গ্রামের পাশে ফরেষ্ট মাঠে সকাল বিকেল সে দৌড়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সঙ্গে জলঙ্গী নদীতে সাঁতার। জল-ঝড়-বৃষ্টি কোনও কিছুতেই ছেদ পড়েনি সেই কঠোর নিয়মে। বাবার অসুস্থতা, সংসারের অভাব— কোনও কিছুই থামাতে পারেনি তাঁকে।

দইয়েরবাজার বিদ্যাপীঠ থেকে যখন সে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে, ততদিনে রোগে ভুগে মৃত্যু হয়েছে তাঁর বাবার। সংসারে তখন চরম সঙ্কট। সাত বছর আগের তেমনই এক দিন হঠাৎই ডাকে এল সেই বহু আকাঙ্খিত চিঠি। তাঁর লড়াই সার্থক। চাকরি পেলেন সিআরপিএফ-এ।

তাঁর পরে একটু একটু করে সংসারের হাল ফিরিয়েছেন তিনি। দাদা রমেশের বিয়ে হয়েছে। তার মধ্যে সিআইএসএফ থেকে চাকরিতে ডাক পেয়েও যাননি। বরং নিজের চাকরিতে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে ডাক পেয়েছেন মাওবাদি দমনে তৈরি বিশেষ বাহিনী ‘কোবরা’য় প্রশিক্ষণের ডাক। বছর দুয়েক আগে সেই প্রশিক্ষণ শেষ হয়। ধুবুলিয়ার হরিণডাঙার দেবশ্রীকে বিয়ে করে সংসার পাতেন বছর দেড়েক আগে।

দীপকবাবুর আত্মীয়রা জানালেন, তাঁদের একান্নবর্তী পরিবার। তাই নিজেদের জন্য একটা বাড়ি তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। বার বার বলতেন, ছুটিতে এসে নিজের বাড়িতে উঠব। বাড়ি তৈরির সব ভার দিয়েছিলেন দাদাকে। রবিবার ফোন করে বাড়ির ছাদ ঢালাইয়ের খবর নিয়েছেন। রাত পার হতে না হতেই এক ফোনেই সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল।

ছুটিতে বাড়ি ফিরলে নিজের বাড়ি তো বটেই, হইচই করে মাতিয়ে রাখতেন পুরো পাড়া। তাঁর কাছে ‘মিলিটারি’ জীবনের গল্প শুনতে আসত গ্রাম।

মাস খানেক আগেও তিনি বাড়ি ঘুরে গিয়েছেন। দাদার হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছেন নতুন বাড়ি তৈরির টাকাও। বলে দিয়েছিলেন, ‘‘বাড়িটা তাড়াতাড়ি শেষ কর দাদা, এবার ছুটিতে এসে নিজেদের বাড়িতে যেন উঠতে পারি।’’

নির্মীয়মান বাড়িটার সামনে বসে ছিলেন হতবাক রমেশবাবু। ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে একটা কথাও বলেন নি। মাঝে মাঝে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছেন ভাইয়ের স্বপ্নের বাড়িটার দিকে। তাঁর কাকিমা বাসন্তী ঘোষ বলেন, ‘‘কথা বলবে কী করে, ও যে ছিল ভাই অন্তপ্রাণ।’’

Maoist attack Cobra jawan Murshidabad killed
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy