Advertisement
১৯ মে ২০২৪
Coronavirus

চাল শেষ, আটা আসেনি, সাগরদিঘির বহু গ্রামে অর্ধাহার-হাহাকার

সাগরদিঘির প্রান্ত কোনায় চাঁদপাড়া গ্রামে পা রাখলে এমন অজস্র সুন্দরী আর কাহাতি সোরেনের ছড়াছড়ি।

খিদের জ্বালা। সাগরদিঘির চাঁদপাড়া গ্রামে। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

খিদের জ্বালা। সাগরদিঘির চাঁদপাড়া গ্রামে। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

বিমান হাজরা
সাগরদিঘি শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২০ ০১:৪৪
Share: Save:

কাহাতি সোরেনের স্বামী চেন্নাইয়ে গিয়ে আটকে পড়েছেন প্রায় হপ্তা তিনেক। খোঁজ নেই তাঁর। তবে এই নিস্তব্ধ তিন হপ্তায় কাহাতি হাড়ে হাড়ে খোঁজ পেয়েছেন অভাবের।

তিন নাবালক ছেলেমেয়েকে রাতের উনুনে ফোটানো এক বাটি বাসি ভাতের সঙ্গে নুন আর দুটো সেদ্ধ আলু মেখে খাওয়াতে পেরেছেন রবিবারের দুপুরে। আর ভাতের মাড়টুকু খেয়েছেন নিজে, চেটেপুটে। কাহাতি বলছেন , “চাল পেয়েছিলাম আট কেজি। ১১ দিন তাই দিয়ে চলল। আজ আর বাড়িতে এক মুঠো চাল নেই। আটা পাব শুনেছিলাম, কিন্তু পেলাম কই?’’

সুন্দরী হেমব্রমের অবস্থাটা আরও একটু অস্বস্তিকর। দুই ছেলে মেদিনীপুরে কাজে গিয়ে আটকে আছেন, তবে কোথায় তা জানেন না। স্বামী-স্ত্রী-শাশুড়ি নিয়ে ছ’জনের পরিবারে রবিবার সকালে ফুরিয়েছে রেশন। আগামী দিনে উনুন জ্বলবে কি না, আকাশের দিকে তাকিয়ে জানালেন, ‘তা জানেন জানগুরু!’

সাগরদিঘির প্রান্ত কোনায় চাঁদপাড়া গ্রামে পা রাখলে এমন অজস্র সুন্দরী আর কাহাতি সোরেনের ছড়াছড়ি। চাঁদপাড়ার ঘরে ঘরে এখন এমনই না-জ্বলা উনুনের ছড়াছড়ি। জেলার সর্বত্র ত্রাণের জন্য অনর্গল ছোটাছুটি। নেতা, পুলিশ, প্রশাসনের ত্রাণ বিলির ঘনঘটায় সাগরদিঘির আদিবাসী গ্রাম চাঁদপাড়া এমনই নিরন্ন অবস্থায় পড়ে।

আরও পড়ুন- হাওড়ার ৬টি ওয়ার্ডে ফোন করলেই মুদিখানার হোম ডেলিভারি

স্থানীয় মণিগ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান লালবানু বিবি মানছেন, শুধু চাঁদপাড়া নয়, তাঁর পঞ্চায়েতেরই আরও তিন আদিবাসী গ্রাম বলরামবাটি, মণিগ্রাম, হাটপাড়া সর্বত্রই এক ছবি। কোনও রাখঢাক না রেখেই বলছেন, ‘‘গত সপ্তাহে ২ কেজি চাল পেয়েছিল, ৩ কেজি আটা পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এখনও তা মেলেনি। ২০ কুইন্টাল চাল এসেছিল মণিগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের ২০টি গ্রামের জন্য। চাঁদপাড়ায় প্রায় তিনশো আদিবাসী পরিবারের ভাগে জুটেছে মাত্র ছ’জনের। খুবই কষ্টে আছে তারা।’’ বিষয়টা বিডিও-র কানে তুলেছেন প্রধান। তবে তাতে সাড়া মেলেনি এখনও।

১১টি গ্রাম পঞ্চায়েতের সাগরদিঘিতে ১৭৮টি গ্রামের মধ্যে আদিবাসী গ্রাম রয়েছে ৩২টি। অলঙ্কার, টোকরডাঙা, আঁতুরফেলা, ওলাহার, পলন্দা, ইটোর প্রত্যন্ত সব আদিবাসী গ্রাম, সব জায়গাতেই কমবেশি চাঁদপাড়ার প্রতিচ্ছবি।

চাঁদপাড়ার পঞ্চায়েত সদস্য অসীম সরকার মণিগ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান। বলছেন, ‘‘প্রায় ২০ হাজার আদিবাসী রয়েছেন সাগরদিঘিতে। প্রতি পরিবারেই স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই দিন মজুর খাটতে বেরিয়ে যায়। সকাল হলেই ট্রেন ধরে আশপাশের গ্রামে গিয়ে দিনভরের পরিশ্রম করে নিয়ে আসেন রাতের অন্ন। কিন্তু তিন সপ্তাহ ধরে সেই ছবি স্তব্ধ। লকডাউন চলায় তাদের কোনও কাজ নেই। আদিবাসী বলে বাড়তি কোনও সাহায্যও তাদের দেওয়া যাচ্ছে না।’’

আরও পড়ুন- লকডাউন: অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে কুয়েত, আমিরশাহিতে কর্মরত ভারতীয়রা

টুকনু সোরেন। বাড়িতেই বেকার বসে স্বামী ২ ছেলে মেয়ে। আলুর খেতে কাজ করে কয়েক কেজি আলু পেয়েছিলেন। কেজি ছয়েক চাল ছিল। সব শেষ। বলছেন, ‘‘শনিবার রাত পর্যন্ত তা চলেছে। বাসি ভাত ছিল, রবিবারের সকালটা চলেছে কোনওরকমে তাই দিয়ে। আজ আর কিছু নেই ঘরে, তাই উনুন জ্বালাইনি। রাতে উপোস ছাড়া গতি নেই । ”

ঘরের পাশেই এক ফালি চাতাল। উপরে খড় বিছোনো। সেখানেই বছর ছয়েকের মেয়ে সাকালিকে খাইয়ে দিচ্ছিলেন মা টগরি হাঁসদা। বাসি ভাত। পাশে রাখা এক দলা শাক। কান্নায় ধরে এল গলা, “ রাতে দুটো ভাত আর একটু শাক বাঁচিয়ে রেখেছিলাম মেয়েটার জন্য। সকাল থেকে দিইনি। এখন খাব বলে কান্নাকাটি করায় দিলাম। দুপুরটা তো মেয়েটা বাঁচল!’’

সাগরদিঘি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তৃণমূলের বেরাজুল ইসলাম বলছেন, “আমি চাঁদপাড়া গ্রামে গিয়েছিলাম। তাদের দুরবস্থা আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি। অনেকেই দু’বেলা খেতে পাচ্ছেন না সেখানে। আশপাশে শাকপাতা, গুগলি এসব সংগ্রহ করত তারা। এই খরায় সে সবও মিলছে না। বিডিওকে বলেছি যাতে ‘জয় জহর’ প্রকল্পে মাসে এক হাজার টাকা ভাতা দেওয়া যায়। তা হলেও কিছুটা উপকৃত হবে পরিবারগুলি।’’

আদিবাসীরা যে সঙ্কটের মধ্যে আছেন তা মানছেন সাগরদিঘির বিডিও শুভজিৎ কুণ্ডুও। বলছেন, ‘‘জোগান না মেলায় আটা দেওয়া যায়নি। তবে দু-এক দিনের মধ্যেই দেওয়া হবে।’’ কাহাতি শুনে বলছেন, ‘‘হবে তো বাবু ঠিক!’’

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE