Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

তুলির টানে রঙিন হয় দগ্ধ ফাগুন

অস্বস্তিটা শুরু হয়েছে কাল রাত থেকেই। হাজার চেষ্টাতেও ঘুমোতে পারেনি ঋত্বিক। চোখ বন্ধ করলেই ফিরে ফিরে এসেছে মুখগুলো।—অ্যাই ঋত্বিককাকু, বেলুনে একটু রং ভরে দেবে?—এই দ্যাখো, এটা কিন্তু রং নয়, আবির গো। চোখ বন্ধ করো। কিচ্ছু হবে না।

শুভাশিস সৈয়দ
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৭ ০০:৫৬
Share: Save:

অস্বস্তিটা শুরু হয়েছে কাল রাত থেকেই। হাজার চেষ্টাতেও ঘুমোতে পারেনি ঋত্বিক। চোখ বন্ধ করলেই ফিরে ফিরে এসেছে মুখগুলো।

—অ্যাই ঋত্বিককাকু, বেলুনে একটু রং ভরে দেবে?

—এই দ্যাখো, এটা কিন্তু রং নয়, আবির গো। চোখ বন্ধ করো। কিচ্ছু হবে না।

— দেব নাকি পাঞ্জাবিটা রঙিন করে? তুমি সেই ভিতুই থেকে গেলে। রং মাখতে এত ভয় পাও কেন?

সকাল এল ঢুলতে ঢুলতে। সঙ্গে চায়ের কাপ আর খবরের কাগজ। মোবাইলে অজস্র রঙিন এসএমএস আর হোয়াটসঅ্যাপ। সবই পড়ে থাকল বিছানায়। সিগারেট ধরিয়ে খত্বিক উঠে গেল চিলেকোঠার ঘরে। প্রতি বছরের মতো। দোল এলেই দোতলার এই ঘরে আরও বেশি করে সেধিঁয়ে যায় সে।

সারাবছর তো বটেই, দোলের আগের রাত থেকেই ঋত্বিকের মনে ভিড় করে বেশ কয়েকটি মুখ। তাদের কেউ ঝরে গিয়েছে জীবন থেকে। কেউ আবার মিলিয়ে গিয়েছে আবছায়ায়। ঋত্বিকের পরিবারের লোকজনও জানে, দোলের দিন নিজের চিলেকোঠার ঘরে দুয়ার এঁটে বসে থাকবে ঋত্বিক। আর জানে বলেই তাঁরা কেউ ছেলেকে বিরক্ত করেন না। তাকে নিজের মতো থাকতে দেয়।

সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ গুমোট পরিবেশ তৈরি করেছে। ঋত্বিকের মনের আকাশেও বিষাদের জমাট মেঘ। আনমনা সিগারেটের ছাই টুপ করে খসে পড়ে পাঞ্জাবির উপরে। সে দিকে খেয়াল নেই। নিঃশব্দে সে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়। হাতে তুলে নেয় রং-তুলি। পুব দিকের দেওয়াল জুড়ে টাঙানো বড় ক্যানভাস। এক হাতে জ্বলছে সিগারেট। অন্য হাতে তুলি। ক্যানভাসে ফুটে ওঠে চেনা মুখ। চেনা হাসি। চেনা মনখারাপ।

ঋত্বিক দত্ত। বয়স ৩২। ছবি আঁকে। আর লেখে। যা প্রাণ চায়। যেমন ইচ্ছে হয়। তামাম বহরমপুর যাকে সংবেদনশীল ও অনুভূতিপ্রবণ মানুষ বলেই চেনে। জানে, পাড়ার শিশু, কিশোর, কিশোরীদেরদের সঙ্গে তার সখ্যতার কথাও। ক্যানভাসে হাসছে নেহা। ভাল নাম শাঁওনী। বসন্ত যায়, আসে। কিন্তু নেহার মুখে সারা বছরই লেপ্টে থাকত বসন্ত।

দোলের দিন সকাল থেকে রং গুলতে ব্যস্ত থাকত নেহা। তখন কতই বা বয়স ছিল! মনে করতে পারে না ঋত্বিক। শুধু মনে আছে মাধ্যমিক দিত সে বার। গুটি গুটি পায়ে ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে আবাসনের নীচে নেমে আসত। তার সঙ্গে বেশ কয়েক জন খুদের দল। ছুড়ে দেওয়া রংবেলুন যখন পথচারীদের শার্টে ক্যানভাস তৈরি করত, উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ত নেহা। সঙ্গে মনভোলানো হাসির

ছটা—‘ঋত্বিককাকু তুমি বেলুনের মধ্যে একটু রং ভরে দেবে? দেখছো তো শেষ হয়ে যাচ্ছে!’

কখনও আবার কানের কাছে মুখ এনে বলত, ‘চলো না কাকু, আর একটু রং কিনে নিয়ে আসি। মাকে কিন্তু বলবে না। প্রমিস?’

টুকরো টুকরো কথার কোলাজ আঁকছে মন। কত কত অভিমান, ছেলেমানুষি, হাসি-কান্না। সব কিছু চোখের সামনে অনর্গল বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে। বুকের ভিতর খাঁ খাঁ তেপান্তর। ঋত্বিকের হাতটা কি একটু কেঁপে উঠল? চোখটা এমন জ্বালা করছে কেন?

কী চেয়েছিল মেয়েটা? বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে। কিন্তু সব বায়না কি বাবা-মা মানতে পারে? সব বায়না কি সব সময় মেনে নেওয়া যায়? ব্যস, অভিমান। ঠোঁট ফুলিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করল মেয়ে। মা জানে মেয়ের রাগ। মা জানে মেয়ের দৌড়। মায়েরা সব জানে। অভিমান করে মেয়ে ঘরে দরজা দিয়েছে। এখনই খুলে বেরিয়ে আসবে। তারপর ফের একপ্রস্ত ভাব-ভাব খেলা। রাগ গলে জল। এমন তো কত বার হয়েছে।

কিন্তু মেয়ে দরজা খোলে না। ধাক্কা দিয়েও সাড়া মেলে না। দরজা ভাঙা হল। ভেঙে পড়ল গোটা বাড়ি। নেহা ঝুলছে। স্থির হয়ে আছে সিলিং ফ্যান। জানলা দিয়ে আসা অবাধ্য হাওয়ায় দুলছে নীল ওড়না। স্বপ্নের রং নাকি নীল? তাহলে মৃত্যুর রং কী?

খুব ছোট থেকেই একা ঘরে ঘুমোতে ভয় পেত যে মেয়ে, বৈভবে বড় হয়ে ওঠা যে মেয়ে এসি ছাড়া ঘুমোতে পারত না, বহরমপুর স্টেশন লাগোয়া লাশকাটা ঘরের প্রায় অন্ধকার জলা-জঙ্গলে ঘেরা আবছায়ায় সেই মেয়ে একা
শুয়ে। একা।

মাথায় হাত রাখে ঋত্বিক। কপালের উপরে ছড়িয়ে থাকা অবিন্যস্ত চুল হাত দিয়ে সে সরিয়ে দেয়। মেয়েটাকে তখনও ফুলের মতো স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। ঠিক যেন ঘুমিয়ে আছে। জেগে উঠবে যে কোনও সময়। যেন জেগে উঠেই বলবে— ‘বসন্ত এসে গিয়েছে? রং খেলবে না ঋত্বিককাকু? ও কাকু...।’

নাহ্, ঋত্বিক আর রং খেলে না। বসন্তও যে এমন পুড়তে পারে, পোড়াতে পারে কে জানত! ঋত্বিকও জানত না। সে শুধু জানে, বসন্তের রং নীল। আর সেটাই মৃত্যুর রং।

মাঝপথে থেমে যায় ঋত্বিক। হাত থেকে খসে পড়ে রং-তুলি। ধপ করে মাটিতে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। ফের পুড়তে শুরু করে আরও একটা সিগারেট। সে উঠে দাঁড়ায়। এ বার ক্যানভাস নয়, ডায়েরির পাতায় সে লেখে—‘বুকে যে আমারও জলের স্লোগান...ভাটিয়ালি গান নয়, জ্বলছে রংমশাল...ভাগীরথীর বুকে ভেসে যায় নৌকা...জানি না যাত্রী কে? শুধু জানি, সাজাতে হবে তরী...ভেসে যাওয়ার কোনও ঠিক নেই...কোনও দিক নেই...কোনও উদ্দেশ্য নেই...জানি, শুধু ভাসতে হবে...।

মার্বেল পাতা মেঝে থেকে ফের সে তুলে নেয় তুলি। ফের সে ফিরে যায় ক্যানভাসের কোলে। কিন্তু কোন মুখের ছবি আঁকবে ঋত্বিক! পাড়া জুড়ে আবাসন তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে। প্রতি দিন নিত্য-নতুন ফ্ল্যাটের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে পুরনো বাড়িগুলি। হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয় মানুষ, প্রিয় মুখ। এখন পাড়ার রাস্তা দিয়ে হাঁটলেই নতুন মুখের সারি।

দোলের মাদকতাও হারিয়ে গিয়েছে সময়ের সঙ্গে। কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না বুলি পিসি, পিঙ্কিদি-শেফালিদিদের। দিলীপকাকুও হারিয়ে গিয়েছে। স্নেহলতা ঠাকুমা নেই কোথাও। পায়রার খোপের মতো ছোট্ট ফ্ল্যাটবাড়িগুলির ড্রইং কাম ডাইনিং থেকে ভেসে আসে হোম থিয়েটারে গান।

ছোট ছোট পরিবারগুলি মেতে ওঠে দোলের আনন্দে। সে আনন্দ শুধু নিজেদের। সে আনন্দ শুধু দুই কিংবা তিন জনের। সেখানে যেন অন্য কারও প্রবেশ নিষিদ্ধ। এটা আনন্দ নাকি আত্মতৃপ্তি? গুলিয়ে যায় ঋত্বিকের। ঠিক তখনই দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে তার।

‘হারিয়ে যাওয়া কি এতই সোজা? হারাব বললেই কি আর হারানো যায়?’ কথাটা মাঝে মাঝেই বলত আত্রেয়ী। এক মুখ হাসি নিয়ে দোলের সকাল থেকেই উড়ে বেড়াত সে। তার সবথেকে প্রিয় ঋতু ছিল বসন্ত। প্রতি বার দোলে রঙিন হয়ে উঠত সে। বালতির জলে রং গুলে পিচকারির মধ্যে ভরে সেই রং সে ঋত্বিকের পাঞ্জাবিতে ছিটিয়ে দিয়েছিল এমনই এক দোলের দুপুরে। সাদা পাঞ্জাবিই হয়ে উঠত ক্যানভাস। রং, তার উপর আবির, তার উপর আবার রং। গোটা পাঞ্জাবি জুড়ে অজস্র বিমূর্ত ছবির ভিড়। তবেই না বসন্ত!

সেই আত্রেয়ীও হারিয়ে গেল দিগশূন্যপুরে। কয়েক বছর আগে এক সন্ধ্যায় মা, ঠাকুমার সঙ্গে পড়ে রইল আত্রেয়ীর নিথর দেহ। পুলিশ বলেছিল, শ্বাসরোধ করে খুন। ওই রকম একটি ফুটফুটে মেয়েকে শ্বাস বন্ধ করে কেউ মারতে পারে? সবাই গেল উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে। শুধু আত্রেয়ীর বসার জায়গাটা ফাঁকা পড়ে রইল। তার সিটের পাশেও খোলা জানলা। কী সুন্দর মিষ্টি হাওয়া।

শহরে মোমবাতি মিছিল বের হল। প্রতিবাদে গর্জে উঠল শহর। শুধু আত্রেয়ীই আর কোনও দিন প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারল না। ক্যানভাসে ততক্ষণে ফুটে উঠেছে আত্রেয়ীর মুখ। কিন্তু সে হাসছে না। গলার কাছে একটা কালো দাগ। চোখে বাঁচার
তীব্র আকুতি।

সে বারও তো এমনই ফাগুন ছিল। কলেজ পড়ুয়া প্রেমিকার বাড়িতে বাসন্তী রং নিয়ে গিয়েছিল রক্তিম চৌধুরী। গালে রং মাখিয়ে সে বলেছিল, ‘পারলে তোর গালে লেগে থাকা আমার রঙিন হাতের ছাপগুলো মুছে ফেলিস।’ সে কথার অর্থ তখনও মেয়েটি বুঝতে পারেনি। শুধু সে বলেছিল, ‘তুই খুব খারাপ মানুষ রক্তিমদা। তুই এ ভাবে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারিস না। শোন রক্তিমদা, দোহাই একটি বার শোন...’’। সে কথা কি রক্তিম আদৌ শুনতে পেয়েছিল?

তার পর থেকে দোল মানে অনিন্দিতাদি’র কাছে কালো রং মেখে বসে থাকার দিন। সময়ের কাছে মাথা ঠুকে অনিন্দিতাদি এখন অন্য ঠিকানায়। রক্তিমদাও নতুন সংসার পাতে। কিন্তু সেই রক্তিমদাও তো হারিয়ে গেল। বছর কয়েক আগে ফাগুনের এক রাতে নিজের ফ্ল্যাটে মায়ের শাড়ি গলায় দিয়ে ঝুলে পড়ল। বাড়িতে কেউ ছিল না। আর সেই সুযোগটাকে হাতছাড়া করতে চায়নি রক্তিম। এমন ভীষণ ভাবে বেঁচে থাকা মানুষটা কেন চলে গেল এ ভাবে? কীসের এত অভিমান? কীসের এত যন্ত্রণা? কার উপরেই বা রাগ?

ঋত্বিক উত্তর খুঁজে পায় না। শুধু এঁকে চলে। নেহা, আত্রেয়ীর পাশে ক্যানভাসে ফুটে ওঠে রক্তিমের মুখও। দোলের দিন মেতে ওঠে গোটা শহর। ঘরবন্দি যুবকের হাতেও রং। সে রঙে রঙিন হয় পোড়া ফাগুন। সে রঙে পুড়তে থাকে ঋত্বিক। সে রঙে ভীষণ ভাবে বেঁচে ওঠে বিষণ্ণ অতীত। কী অদ্ভুত! বসন্তের শেষেও তো অন্ত কথাটা লেপ্টে রয়েছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Holi Painter Canvas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE