Advertisement
E-Paper

কেউ লাল কেউ দুধ-সাদা, দই দিয়ে যায় চেনা

ছুরি ছাড়া সে দই কাটা যায় না বলে শহরে ‘চাক্কু দই’ নামেও বাজারে তার পরিচিতি। এখনও আছে, রসগোল্লার জিআই প্রাপ্তির বাজারে লাল দইয়ের অভিমান কম নয়!

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৭ ০২:৩১

দই কিনতে গিয়ে ভদ্রলোক বলে বসেছিলেন, ‘‘দেখবেন দইটা যেন ভাল হয়!’’ দোকানি কেজি আড়াইয়ের হাঁড়িটা সটান উপুড় করে দিলেন সামনে। হাঁ হাঁ করে উঠলেন ভদ্রলোক, ‘‘আরে করেন কী?’’ দোকানি নির্বিকার মুখে দইয়ের ওলটানো হাঁড়ি সজোরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলছেন, “মশাই, এর নাম নবদ্বীপের লাল দই। ছুরি না চালালে এক ফোঁটা দই পড়বে না।” নবদ্বীপের লাল দইয়ের সেরা বিজ্ঞাপন।

ছুরি ছাড়া সে দই কাটা যায় না বলে শহরে ‘চাক্কু দই’ নামেও বাজারে তার পরিচিতি। এখনও আছে, রসগোল্লার জিআই প্রাপ্তির বাজারে লাল দইয়ের অভিমান কম নয়!

তা হলে আসুন পড়শি জেলা মুর্শিদাবাদে ঘুরে আসি। সেখানে দইয়ের রং দুধ-সাদা। দোকানি বলেন, ‘‘হাঁড়ির কাছে মুখ আনুন স্পষ্ট দেখতে পাবেন নিজেকে।’’ চালু লব্জ, শক্তিপুরের সেই সাদা দইয়ের হাঁড়ি নিয়েই তামাম মুর্শিদাবাদ জামাইষষ্ঠীতে শ্বশুরবাড়ির পথ ধরে।

সালার, রেজিনগর, সাটুই, রামনগরেও সাদা দইয়ের কদর আছে, তবে শক্তিপুরের মতো তেমন মর্য়াদা নেই। প্রায় একশ বছর ধরে শক্তিপুরের সাদা দইয়ের আধিপত্য। তিন রকম স্বাদে শক্তিপুরের সাদা দই মেলে। টক, মিষ্টি আর মাঝারি স্বাদের। দাম প্রতি কেজি প্রতি একশো টাকা। ও পথে গেলে না খেয়ে ফিরবেন না কিন্তু!

তবে, লাল দইয়ের সঙ্গে তার রেসিপিতে রয়েছে ঢের অমিল। বাঁটা চন্দনের মতো মোলায়েম লালচে রঙের সুমিষ্ট দই নিয়ে নবদ্বীপের গর্বের শেষ নেই। শ্রীচৈতন্য, বৃহৎতন্ত্রসারের মতো আরও যে সব বিষয় নিয়ে একদা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হয়ে উঠেছিল নবদ্বীপ, পোড়া-লাল দই সেই তালিকায় অন্যতম।

দই বা দধি মিষ্টান্ন পরিবারের কুলীন সদস্য। তবে সে সব দইয়ের শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করা হত তার শুভ্রতা দিয়েই। সেই দই হঠাৎ লাল হয়ে উঠল কেন? এ সম্পর্কে নবদ্বীপের প্রবীণ মানুষ এবং বংশানুক্রমিক মিষ্টান্ন কারিগরদের কাছ থেকে যা জানা যাচ্ছে, তাতে লাল দইয়ের জন্ম ১৯৩০ সালের আশেপাশে। লাল দই তৈরি করেছিলেন নবদ্বীপ ফাঁসিতলার বাসিন্দা এবং মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক কালী ঘোষ। ওই এলাকার পুরপিতা গোষ্ঠবিহারী ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন কালী ঘোষ এবং হরি ঘোষ ছিল দুই ভাই। তাঁরা মূলত দই এবং ঘোল তৈরি করতেন। মরা আঁচে মোষের দুধে অল্প অল্প জল দিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে ফুটিয়ে দুধকে ঘন করতেন। অনেকক্ষণ জ্বাল দেওয়ায় সেই দুধের রঙ লালচে হয়ে যেত। তাই দিয়ে ঘোল তৈরি করতেন দুই ভাই। তাঁদের ঘোল এলাকায় লাল ঘোল নামে পরিচিত ছিল।

কালী ঘোষের নাতি রাজু ঘোষ বলেন, ‘‘লাল ঘোল থেকেই লাল দইয়ের ভাবনা। লালচে ঘন দুধের ঘোল সুস্বাদু হলে দই আরও স্বাদু হবে।’’ লাল দইয়ের হদিস দিতে গিয়ে ওই ফাঁসিতলার আর এক পারিবারিক মিষ্টান্ন কারিগর উৎপলকুমার ঘোষ বলেন, “আমার বাবা প্রয়াত নৃপেন্দ্র ঘোষের মুখে শুনেছি সেকালে লাল ঘোলের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। তাই দেখে কালী ঘোষ লাল দইয়ের পরিকল্পনা করেন। শুরু থেকেই বাজার মাত করে দেয় লাল দই।”

তবে লাল দইয়ের আবিষ্কর্তা হিসাবে নবদ্বীপ আরও একজনের নাম শোনা যায়। তিনি কালীপদ মোদক। সে কালে কলকাতা থেকে কোচবিহার তাঁকে চিনত কালী ময়রা নামে। অনেকে বলেন তিনিই প্রথম লাল দই তৈরি করেন। এ প্রসঙ্গে নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব জানান, কালী ঘোষ এবং কালী মোদক দুজনে প্রায় একই সময়ে নবদ্বীপ মিষ্টান্ন ব্যবসা শুরু করেন। কে আগে কে পরে তা নিয়ে অবশ্য নানা বিতর্ক আছে।’’

ওঁদের পাশাপাশি সেকালে নবদ্বীপ নিত্যহরি ঘোষের ‘সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের’ লাল দইও ছিল জনপ্রিয়। এখনও রামকৃষ্ণ ঘোষ, পাঁচুগোপাল দাস, রাধেশ্যাম সাহা, উৎপল ঘোষ, প্রতুল গোস্বামীরা সুনামের সঙ্গেই লাল দই তৈরি করে চলেছেন পুরানো ঐতিহ্য মেনে। তাই এখনও লাল দই তৈরি হয় কাঠের উনানে ছ’ থেকে সাত ঘণ্টা ঢিমে আঁচে দুধ জ্বাল দিয়ে। দুধে যতক্ষন না লাল রঙ ধরবে ততক্ষণ ‘ফুট’ চলতেই থাকবে। দুধ তৈরি হয়ে গেলে মাপ মতো মাটির পাত্রে ওই দুধ ঢেলে নিভন্ত উনানের চারপাশে ঘিরে বসিয়ে দেওয়া হয় নানা মাপের মাটির হাঁড়ি। গায়ে জড়িয়ে দেওয়া হয় চট। ওই ভাবেই রাত্রি যাপন। সকালে হাঁড়িতে দই জমে পাথর। কোন বাইরের রঙ ছাড়াই ওই লালরঙে পৌঁছানোই নবদ্বীপের কারিগরদের মুন্সিয়ানা।

Curd Nabadwip নবদ্বীপ
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy