তেহট্ট হাইস্কুলের মাঠে চলছে ফুটবল প্রশিক্ষণ।—নিজস্ব চিত্র।
দিনকয়েক আগের এক বিকেলবেলা। তেহট্ট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে নানা রঙের জার্সি আর জুতো পরে প্রায় শতাধিক খুদে খেলোয়াড় অনুশীলনে ব্যস্ত। সকলের বয়স সাত থেকে বারো বছরের মধ্যে। তাদের সঙ্গে রয়েছেন এলাকার সাত জন প্রশিক্ষক। মিনিট কুড়ি শরীরচর্চার পরে শুরু হল ফুটবল। মাঠের বাইরে বসে ছেলেদের অনুশীলন দেখছেন মায়েরা।
গত ছ’মাস ধরেই বিকেল হলেই এমন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে তেহট্টের স্কুল মাঠে। ছেলে সৌম্যদীপ দত্তকে মাঠে নিয়ে এসেছিলেন সোমা দত্ত। তাঁর কথায়, ‘‘লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলোটাও জরুরি। বাড়ির কাছেই ফুটবল মাঠ। যখন শুনলাম সেখানে ফুটবলের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, তখন আর দেরি করিনি।’’ আর একজন অভিভাবিকা তুলসী দত্ত বলছেন, ‘‘ছেলে এখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। স্কুলের পরে বাড়িতে বসেই হয় কার্টুন দেখত, নয়তো ঘুমিয়ে কাটাত। এ ভাবে কখনও সুস্থ থাকা যায়!’’
এখন রোজ বিকেলে সংসারের হাজার ঝামেলা সামলেও ছেলেদের মাঠে নিয়ে আসছেন এমন অনেকেই। ফুটবল মাঠের এমন জমজমাট চেহারা থেকে তেহট্টের মনে পড়ে যাচ্ছে পুরনো দিনের কথা। অনেকেই ভাবছেন যে, তেহট্টের খেলাধুলার হারানো অতীত বোধহয় ফিরে আসছে। একসময় সীমান্ত লাগোয়া তেহট্ট দাপিয়ে ফুটবল খেলা হত। একদিন ঘরের মাঠেই ভাল খেলেই গুজরাতে রাজ্য দলে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন তেহট্টের দশরথ মণ্ডল। ফুটবলের জোরেই পেয়েছিলেন সরকারি চাকরিও। তারপরে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। অমিতাভ বিশ্বাসও ফুটবল খেলেই রেলে চাকরি পেয়েছিলেন। একই ভাবে ভাল অ্যাথলেটিক হওয়ার সুবাদে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন তেহট্টের আদিত্য বিশ্বাস। ওই এলাকার সুনীল হালদার, বিশ্বজিৎ বিশ্বাস কিংবা অসীম দেবনাথের মতো অনেকেই বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত যাঁরা সকলেই একসময় ভাল খেলোয়াড় ছিলেন।
তবে সকলেই যে এমন উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়তে পেরেছেন তা কিন্তু নয়। তেহট্টের অ্যাথলেটিক আনন্দ দাস ও রেখা মাল দু’জনেই বছর আটেক আগেও রাজ্য স্তরে দৌড়ে অনেককে পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন। এখন তাঁরা অতি কষ্টে বেঁচে আছেন। একসময় জেলা ও বাংলার হয়ে খেলতেন তেহট্টের কড়ুইগাছির অনুপম কর্মকার কিংবা নওদাপাড়ার কাসেম মোল্লা। তাঁদের অবস্থাও তথৈবচ। কেউই তাঁদের খোঁজ রাখেনি। কিন্তু তেহট্টের মাঠের এই নতুন চেহারার খবর শুনে খুশি তাঁরাও।
তেহট্টের বাসিন্দা তথা নদিয়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক গৌতম বিশ্বাস জানান, তেহট্টে খেলার স্বর্ণযুগ ছিল সাতের দশকে। ১৯৭২ সালে এলাকার ক্রীড়াপ্রেমী মানুষের উদ্যোগে তেহট্ট ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি হয়েছিল। তখন একটা সময় ছিল যখন ছেলেরা ভালবেসে মাঠে খেলতে আসত। কিন্তু পরিবেশ, পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে এলাকার খেলাধুলোয় ভাটা পড়ে। এলাকার প্রাক্তন ফুটবলার অনুপম কর্মকার বলেন, ‘‘কয়েক দশক আগে খেলা বলতে উন্মাদ ছিলেন এলাকার মানুষ। বিশেষ করে ফুটবল নিয়ে এলাকার মানুষের আগ্রহ ছিল দেখার মতো। কিন্তু পরবর্তীতে নতুন প্রজন্ম মাঠ থেকে ক্রমশ দূরে চলে গেল। আমরাও তাদের মাঠমুখী করতে পারলাম না।’’ তিনি জানান, গত বছর থেকে তেহট্টের শুভাকাঙ্ক্ষী কিছু মানুষের প্রচেষ্টায় ফুটবল কোচিং ক্যাম্প শুরু করা হয়েছে। অনূর্ধ্ব ১৪ বিভাগে প্রথমে মাত্র ২০ জনকে নিয়ে শুরু হয়েছিল সেই ক্যাম্প। এখন সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে একশো কুড়ি। সঙ্গে তাদের অভিভাবক কিংবা অভিভাবিকারাও আসছেন। এটা অত্যন্ত ভাল লক্ষ্মণ।
তেহট্ট আঞ্চলিক ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক সুমিত বিশ্বাস জানান, ১৯৭৭ সালে তৈরি হওয়া ক্রীড়া সংস্থার অধীনে বর্তমানে প্রায় ৩৪টি অনুমোদিত ক্লাব খেলে। প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল ও ক্রিকেট লিগ। এখন ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেটেও জোয়ার এসেছে তেহট্টে। গত কয়েক বছর থেকে সিএবি পরিচালিত কোচিং ক্যাম্পে ক্রিকেটেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে স্থানীয় ছেলেমেয়েদের। সেই ক্যাম্প থেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে আজ বেতাইয়ের প্রিয়াঙ্কা বালা বাংলার হয়ে খেলছে অনূর্ধ্ব ১৯ দলে। তেহট্ট জোনে নতুন করে একটি মহিলা ফুটবল দলও তৈরি হয়েছে।
তবে সমস্যাও কিছু কম নেই। এলাকায় খেলার মাঠের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। সুমিতবাবু জানান, বয়ারবাঁধা, শ্যামনগর কিংবা তেহট্ট হাই স্কুলের মাঠের মতো হাতেগোনা কয়েকটি মাঠে খেলা হয়। তেহট্ট মহকুমায় এখনও পর্যন্ত কোনও স্টেডিয়াম নেই। বয়ারবাঁধা মাঠে একটা স্টেডিয়াম তৈরির জন্য জেলায় প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। ক্লাবগুলোও চরম আর্থিক দুরাবস্থায় ভুগছে। তেমন ভাবে স্পনসরও জোটে না। প্রায় সাত জন প্রশিক্ষক বিকেলে বাচ্চাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বিনা পারিশ্রমিকে। এ ভাবে কতদিন চলবে সেটাই প্রশ্ন। সুমিতবাবু বলেন, ‘‘তবুও আমরা হাল ছাড়তে রাজি নই। অনেকদিন পরে খেলার মাঠে খরা কেটেছে। এই ধারাটা বজায় রাখতেই হবে। আগামী বছর থেকে টেবিল টেনিস খেলা চালু করার ইচ্ছেও রয়েছে।’’
তেহট্টের ফুটবল প্রশিক্ষক চন্দন বিশ্বাস, সুজিত মণ্ডলরা বলছেন, ‘‘সবার আগে বাবা-মায়েদের বোঝা উচিত যে, পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলোটাও জরুরি। এখন অনেকেই সেটা বুঝে তাঁদের সন্তানদের মাঠে পাঠাচ্ছেন। এই ধারাটা বজায় রাখলে তেহট্টের খেলাধুলোর সামগ্রিক চেহারাটাই বদলে যাবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy