Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কন্যাশ্রীদের গুরুদক্ষিণা, জাকিরনকে নিয়ে শ্রুতিনাটক

জাকিরন যাই বলুন না কেন, গত কয়েক বছরে তিনি যে অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে একের পর এক নাবালিকা বিয়ে রুখে দিয়েছেন তা জানে তামাম মুর্শিদাবাদ।

চলছে মহলা: নিজস্ব চিত্র

চলছে মহলা: নিজস্ব চিত্র

মফিদুল ইসলাম
হরিহরপাড়া শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৯ ০২:০৭
Share: Save:

একটার পর একটা ফোন আসছে।

সকালে ফোন এল হরিহরপাড়ার প্রত্যন্ত কোনও পাড়া থেকে, ‘ও আপা, শিগ্‌গির এসো গো। বয়স হয়নি। তা-ও বিয়ে দিচ্ছে।’

পড়ে রইল গেরস্থালি। পড়িমড়ি ছুটলেন তিনি।

বিকেলে ফোন এল অন্য পাড়া থেকে। ভয়ার্ত গলায় ফিসফিস করছে কেউ, ‘আমি তো পড়তে চাই। কিন্তু ওরা কেউ আমার কথা শুনছে না। আজ রাতেই বিয়ে।’

পাতেই রইল রাতের খাবার। ফের ছুটলেন তিনি।

আগে একা ছুটতেন। এখন তাঁর সঙ্গী যোদ্ধা। কন্যাশ্রী যোদ্ধা। সেই যোদ্ধারাই এ বার তাদের ‘জাকিরন আপা’কে নিয়ে শ্রুতিনাটক করছে। আজ, বুধবার কন্যাশ্রী দিবসে হরিহরপাড়া ব্লক প্রশাসন ভবনে সেই শ্রুতিনাটক পরিবেশন করবে তারা।

হরিহরপাড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম ডাঙাপাড়ার বাসিন্দা জাকিরন বিবি লাজুক হাসছেন, ‘‘ব্লকের সরকারি আধিকারিক আর মেয়েদের কাণ্ডটা দেখুন এক বার! আমি সামান্য মানুষ। আর সেই আমাকে নিয়েই কি না ওরা নাটক লিখে ফেলেছে!’’

জাকিরন যাই বলুন না কেন, গত কয়েক বছরে তিনি যে অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে একের পর এক নাবালিকা বিয়ে রুখে দিয়েছেন তা জানে তামাম মুর্শিদাবাদ। ব্লক প্রশাসনের হিসেব অনুযায়ী, ১০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জাকিরন ও কন্যাশ্রী যোদ্ধারা ১৪০ জন নাবালিকার বিয়ে রুখে দিয়েছেন। প্রত্যন্ত গাঁ-গঞ্জে, মোড়ল-মাতব্বরদের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে এই কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। সহ্য করতে হয়েছে অপমান, উপেক্ষা এমনকি হেনস্থাও হতে হয়েছে। তবুও তিনি দমে যাননি।

জাকিরন বলছেন, ‘‘আসলে কী জানেন, যখনই কোনও নাবালিকার বিয়ের খবর আসে তখন আমি ফোনের ওপ্রান্তে আমাকেই দেখতে পাই। আমার নিজেরও তো বিয়ে হয়েছিল ১৫ বছর বয়সে। তাই পণ করেছি, আমার যাই হোক না কেন, নাবালিকা বিয়ে আমি কিছুতেই হতে দেব না।’’

চোয়া বি বি পাল বিদ্যানিকেতনের দশম শ্রেণির ছাত্রী পূজা বিশ্বাস বলছে, ‘‘ভাগ্যিস জাকিরন দিদি এমন ধনুকভাঙা পণ করেছিলেন। নইলে আমারও যে কী হত, কে জানে!’’ কথাটা কিন্তু কথার কথা নয়। পূজার তখন ক্লাস সেভেন। বাড়ি থেকে বিয়েরও ঠিক হয়। ব্যস, খবর পেয়েই ছুটলেন জাকিরন। বন্ধ হল বিয়ে। সেই পূজাই এ বার শ্রুতিনাটকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। পূজা বলছে, ‘‘জাকিরুন দিদিই আমার গুরু। আর, এটাই আমার গুরুদক্ষিণা।’’

বাল্যবিবাহ তো বটেই, নারী ও শিশু নির্যাতন, পাচারের মতো নানা সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই করে জাকিরন এখন হরিহরপাড়া তো বটেই মুর্শিদাবাদ জেলার উজ্জ্বল মুখ। ইতিমধ্যে তিনি নানা জায়গা থেকে পেয়েছেন সম্মান, সংবর্ধনা ও স্বীকৃতি। তার পরেও জাকিরনের অভিধানে আত্মতুষ্টি বলে কোনও শব্দ নেই। তিনি বলছেন, ‘‘যত দিন বেঁচে থাকব, এই কাজটাই করে যাব। আজ যে নাবালিকাদের বিয়ে বন্ধ করা হল তারাও যে দিন থেকে অন্য নাবালিকাদের বিয়ে বন্ধ করতে শুরু করবে, দেখবেন জেলা তো বটেই দেশের চেহারাটাও বদলে যাবে।’’

শ্রুতিনাটকটি লিখেছেন ব্লকের সমিতি এডুকেশন অফিসার অসীম তরফদার। তিনি বলছেন, ‘‘জাকিরনদিদির কর্মকাণ্ড খুব কাছ থেকে দেখেছি। সেগুলিই শ্রুতিনাটকে উঠে এসেছে। তেরো জন কন্যাশ্রী যোদ্ধা নাটকটি পরিবেশন করবে।’’

নাটকটির নাম? জাকিরন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Teenage Marriage Kanyashree Kanyashree Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE