Advertisement
E-Paper

জেদের উড়ানে স্বপ্নপূরণ নাজিরের

নাজির তাঁর লক্ষ্যে স্থির। লেখাপড়া জানার কারণে পাড়া কিংবা গ্রামের প্রয়োজনে তাঁকে মাঝেমধ্যে পঞ্চায়েত কিংবা ব্লক অফিসে যেতে হতো। সেখানে তিনি দেখতেন, রকমারি সব সমস্যা নিয়ে লোকজন আসেন সরকারি অফিসে। কারও কাজ হয়, কেউ চোখের জল মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরে যান।

মনিরুল শেখ

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৭ ১০:১০
অফিসে বিডিও। নিজস্ব চিত্র

অফিসে বিডিও। নিজস্ব চিত্র

স্বপ্ন দেখতেও আবার সাহস লাগে নাকি?

আটপৌরে চেয়ারটা সরিয়ে তিনি বলছেন, ‘‘আলবাত! তবে সেটা নির্ভর করে আপনি কী রকম স্বপ্ন দেখছেন।’’

টেবিলে রাখা পেপার-ওয়েটটা মুঠোয় বন্দি করে তিনি বলে চলেছেন, ‘‘স্বপ্ন, জেদ এবং পরিশ্রম— এই তিনটিতে যদি কোনও ফাঁকি না থাকে, সাফল্য কেউ আটকাতে পারবে না। আর কী জানেন তো, স্বপ্নপূরণের একটা দিন ঠিক করে ফেললে সেটা আর স্বপ্ন নয়, লক্ষ্য হয়ে যায়।’’

এগুলো যে কথার কথা নয় তা নিজেই করে দেখিয়েছেন নাজির হোসেন।

কে এই নাজির?

আপাতত তাঁর পরিচয় কালীগঞ্জের বিডিও। দিন দশেক আগে তিনি ব্লকের দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু রাজ্যজুড়ে বিডিও-র সংখ্যা তো নেহাত কম নয়। তা হলে নাজির ব্যতিক্রম কেন?

নাজিরের সহপাঠী, শিক্ষক, বন্ধু, পরিবারের লোকজন বলছেন, ‘‘ওঁর লড়াইয়ের জন্য।’’

কথাটা কথার কথা নয়। উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসাতের প্রত্যন্ত গ্রামে নাজিরের বাড়ি। বাবা প্রান্তিক চাষি। মেরেকেটে বিঘেখানেক জমি। পাঁচ জনের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। অথচ সেই ছাত্রাবস্থা থেকে নাজিরের স্বপ্ন—ডব্লিউবিসিএস পাশ করে বিডিও হওয়ায়।

যা শুনে কেউ উৎসাহ দিতেন, কেউ কাটতেন টিপ্পনি। কিন্তু নাজির তাঁর লক্ষ্যে স্থির। লেখাপড়া জানার কারণে পাড়া কিংবা গ্রামের প্রয়োজনে তাঁকে মাঝেমধ্যে পঞ্চায়েত কিংবা ব্লক অফিসে যেতে হতো। সেখানে তিনি দেখতেন, রকমারি সব সমস্যা নিয়ে লোকজন আসেন সরকারি অফিসে। কারও কাজ হয়, কেউ চোখের জল মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরে যান। নাজিরের কথায়, ‘‘এ সব দৃশ্য তাঁর জেদ আরও বাড়িয়ে দিত। ভারী পর্দা সরিয়ে অনেকেই ঢুকতেন বিডিও-র ঘরে। সেই এক মুহূর্তে দেখতাম, বিডিও সাহেব কত কী কাজ করছেন। মনে মনে নিজেকে ওই জায়গাতেই দেখতাম।’’ বছর দুয়েক আগে ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষার তিন স্তরেই উত্তীর্ণ হন নাজির। ২০০৯ সালে নাজির বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ওই বছরেই তিনি ‘নেট’ উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে পড়ানোর ছাড়পত্রও পেয়ে যান। কিন্তু তিনি সে পথে হাঁটেননি। চাকরি নেন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে। কিন্তু সেখানে তো থাকলে চলবে না।

চাকরির পাশাপাশি রাত জেগে চলতে থাকে পড়াশোনা। পরিশ্রমের ফল মিলল ২০১২ সালে। সে বছর তিনি ডব্লিউবিসিএসে ‘গ্রুপ-বি’ তে সুযোগ পান। পুলিশের ডিএসপি হিসেবে কাজ যোগ দেওয়ার নিয়োগপত্র মেলে। কিন্তু তিনি যোগ দিলেন না। কারণ, সেখানে তো সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ কম। আইন-শৃঙ্খলা নিয়েই কেটে যাবে দিনরাত। ফের শুরু হল পড়াশোনা। পরের বছরেই এল সাফল্য। ২০১৩ সালে তিনি ডব্লিউবিসিএসে প্রথম হন। অবশ্য চূড়ান্ত ফল বার হয় ২০১৫ সালে। শুরু হয় প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ পর্বে কলকাতা, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদে নানা জায়গায় কর্মরত ছিলেন তিনি।

এখন নাজির কালীগঞ্জের বিডিও। তিনি বলছেন, ‘‘ঠান্ডা ঘরে বসে সমস্যা জানা সম্ভব নয়। যেতে হবে গ্রামে গ্রামে। ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে প্রকল্পের কাজ।’’ আর কাজ-পাগল নাজিরের সৌজন্যে এখন ঘুম ছুটেছে ব্লক অফিসের কর্মীদের। ব্লকের এক কর্মী বলছেন, ‘‘বিডিও সাহেব নিজে সপ্তাহে তিন দিন গ্রামে গ্রামে যাচ্ছেন। স্কুল-রাস্তাঘাটের হাল দেখছেন। আমরা কী করে বসে থাকি বলুন তো?’’

নাজিরের ঘরেও এখন ভারী পর্দা ঝুলছে। সেটা নড়ে উঠলে কি আজও কোনও স্বপ্নদেখা কিশোরের দেখা মেলে?

চোখের কোনটা চিকচিক করছে নাজিরের। স্বপ্ন নাকি সাফল্যের আনন্দ?

‘বিডিও সাহেব’ হাসছেন।

Struggle Live Struggle
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy