বিসর্জনের ঢাকের আওয়াজে মিশে গেল মহরমের জারি গানের শোকের সুর।
হিজরি ৬১ সালের ৮-ই মহরম তারিখে নবি কূলোদ্ভূত মদিনাপতি হজরত ইমাম হুসেন ঘটনাচক্রে সপরিবার কারবালা ময়দানে উপস্থিত হতে বাধ্য হন এবং এজিদের সৈন্যদের হাতে কারবালা প্রান্তরে মারা যান। সেই ঘটনাই ‘মহরম’ নামে পরিচিত। আর কারবেলা প্রান্তের সেই ঘটনা নিয়েই রচিত জারি গান মহরমে গাওয়া হয়ে থাকে।
লালবাগে নবাব বংশের ১০-১২ জন মহিলা রয়েছেন, যাঁরা জারি গান করে থাকেন। তাঁরা মহরমের দিন জারি গান করা ছাড়াও বছরের অন্যান্য দিন জেলার বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে ঘুরে জারি গান করে থাকেন। বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে জারি গান গাওয়ার জন্যেও তাঁদের ডাক পড়ে। মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রথম (সম্ভবত রাজ্যেও প্রথম বার) ২০০৬ সালে বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে জারি গানের উপরে তিন দিনের কর্মশালার আয়োজন করে জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর। তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি জেলা আধিকারিক তথা বর্তমান তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের উপ-অধিকর্তা (চলচ্চিত্র) মালা মৈত্র বলেন, ‘‘শিয়া সম্প্রদায়ের মহিলারা তাজিয়া তৈরি করে জেনানা মহলের মধ্যে জারি গান পরিবেশন করতেন। ওই কর্মশালা উপলক্ষে প্রথমবার তাঁরা অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে এসে মঞ্চে জারি গান পরিবেশন করেন।’’
জারি গানের গবেষক মালাদেবী জানান, মুসলিম মহিলারা পুরাণকে কেন্দ্র করে জারি গান করে থাকেন। তবে নিয়মিত কর্মশালার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ নতুন কিছু জারি গান লেখা হচ্ছে কি না অথবা জারি গানের সুরের কোনও বদল ঘটছে কি না, তা-ও জানা প্রয়োজন। যেমন উত্তরবঙ্গের গানে ভাওইয়াগানের সুর ঢুকে গিয়েছে, তেমনই মুর্শিদাবাদের জারি গানে বাউলের সুর আছে। আবার মুর্শিদাবাদের জারি গানে লখনউ ও দিল্লি ঘরানার সুর আছে।
মহরমকে কেন্দ্র করে লালবাগে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শতাধিক জারি গানের দল আসে। মহরম উপলক্ষে তাঁরা সারা রাত জাগে। কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে জারি গান গাওয়া হয়। কখনও ইমাম হুসেনের মেয়ে তসলিমা, কখনও বোন জৈন্নত, কখনও ভাই হজরত আব্বাস, ইমাম হাসানের ভাইয়ের ছেলে হজরত কাশিম, ইমাম হুসেনের বীর যোদ্ধা আলমকে নিয়ে জারি গান করা হয়। মহরমের দিন কালো পোশাক পরে জারি গান করলেও অনুষ্ঠান মঞ্চে কালো বোরখা পরে জারি গান করেন ওই মহিলারা। জারি গানের মধ্যে দিয়ে যে শোকের পরিমণ্ডল তৈরি হয়। কালো পোশাক তারই প্রতীক। যেমন, কারবালা প্রান্তরে ইমাম হুসেনকে পাথরের উপরে মাথা রেখে শিরোচ্ছেদ করার ঘটনা নিয়ে জারি গান—‘‘হ্যাঁ আজ ভি গিরিয়া হ্যাঁ আজ ভি জারি/ হ্যাঁ আজ ভি পাত্থর কে পিনে সে লহু জারি...।’’ জারি গানের বিভিন্ন শ্রেণি রয়েছে—১) ধুয়ো জারি। কীর্তনের মতো গাওয়া হয়। দলের প্রধান তিনি এক লাইন গাইবেন। তাঁর গাওয়া শেষ হওয়ার পরেই দোহাররা গানটা ধরে নেন। ২) মরশিয়া ৩) নৌহা ৪) জারি নাটক বা জারি যাত্রা ৫) আধুনিক জারি ৬) মাতম্ জারি ৭) কাওয়ালি জারি বা গজল।
নদিয়া জেলার ধুবুলিয়া থানার সোনডাঙার সহিদুল শেখের জারি গানের দল রয়েছে। তিনি গত ছ’বছর ধরে জারি গান করছেন। পেশায় গ্রাম্য চিকিৎসক সহিদুল শেখ বলেন, ‘‘গুরু ইদো শেখের কাছ থেকে জারি গান গাওয়া শিখেছি। এখন মহরম ছাড়াও জেলার বিভিন্ন প্রান্তে জারি গানের দল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়।’’ মহরম উপলক্ষে বামুনপুকুর দরগাতলায় প্রতি বছর জারি গানের প্রতিযোগিতা হয়, সেই প্রতিযোগিতাতেও তাঁর দল অংশ নেবে বলেও তিনি জানান। আবার চাপড়ার হাটরা গ্রামের অশীতিপর হাজিবুদ্দিন শেখ প্রায় ৫০ বছর ধরে জারি গান করে চলেছেন। পেশায় কৃষক ওই জারি শিল্পী বলেন, ‘‘গুরুর তাহিরুদ্দিন মণ্ডলের কাছ থেকে জারি গান শিখেছি। নানা প্রান্তে জারি গান করেই কেটে যায়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy